সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

রুপন্তির মোবাইল আসক্তি

আলমগীর খোরশেদ
  ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

ক্লাসে হোয়াইট বোর্ডে মিসের লেখাগুলো পেছনে বসে দূর থেকে অস্পষ্ট লাগে রুপন্তির। খাতায় অনুমানে লিখতে গিয়ে ধমক খেলো মিসের। মিস জিজ্ঞেস করলেন,

\হ'রুপন্তি, ভয়েস পরিবর্তনের নিয়ম সবগুলো কি লিখেছো খাতায়'?

মিস, কিছু শব্দ পড়তে পারছি না।

মানে কি? দাঁড়াও কয়েকজন পড় আমার লেখাগুলো।

দেখা গেল অনেকেই পড়তে পারছে না। অস্পষ্ট লাগে চোখে। মিস সবাইকে বলে দিলেন,

\হতোমাদের অভিভাবকদের বলবা, মিস বলেছেন, ডাক্তারের কাছে গিয়ে চোখের পরীক্ষা করাতে, বুঝেছো?

বাসায় এসে জানালে রুপন্তির আব্বু সোলেমান সাহেব রুপন্তিকে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার কম্পিউটার দিয়ে রুপন্তির চোখ পরীক্ষা করে জানালেন,

'রুপন্তি মনে হয়- খুব বেশি সময় মোবাইল ব্যবহার করে, তাই না?

'হঁ্যা, তা তো করেই। আজকাল লেখাপড়াও মোবাইল-বেইজড হয়ে গেছে। কি দেখলেন ডাক্তার সাহেব'?

'রুপন্তির চোখে মায়োপিয়া হয়েছে।'

'এটা কী রোগ ডাক্তার সাহেব? কঠিন বা খারাপ কিছু?

'দূরের জিনিস একেবারেই ঝাপসা দেখা, মাথা ব্যাথা, চোখের দুইপাতা খুব কাছাকাছি এনে তাকানো এসব হলো মায়োপিয়া রোগের লক্ষণ। মোবাইল আসক্তির জন্যই এটা হয়।

'ডাক্তার সাহেব, এখন কি হবে'? -রুপন্তির আম্মু জিজ্ঞেস করলেন।

\হ'দীর্ঘক্ষণ মোবাইল, ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের রেটিনা, কর্নিয়া এবং অন্যান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিশুদের। মোবাইল ব্যবহারের সময় এটা থেকে নিঃসৃত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টি শক্তির ভীষণ ক্ষতি করে, এভাবেই শিশুরা মায়োপিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

'ওরা কার্টুন ছাড়া খেতে পারে না ডাক্তার সাহেব'।

'আসলে এমন একটা সফটওয়্যার তৈরি করা প্রয়োজন যা শিশুরা ঠিক কতক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারবে তা সীমিত করে দেবে। এক্ষেত্রে 'ডিজিটাল লক' একটিভ হয়ে কাজটা করবে।

'এমন হলে তো ভালোই হয়'।

\হ'মনে রাখবেন, টাচস্ক্রিন ব্যবহারে শিশুদের আঙুলের পেশি সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে বাধা পায়। প্রযুক্তি শিশুদের নীরবে ধ্বংস করে দিচ্ছে'।

' কথা শোনে না, আজকালের বাচ্চারা'।

'ওরা ছোট, বুঝে না। তাই কাউন্সিলিং করতে হবে। জানেন তো, দুই মিনিট স্থায়ী একটি মোবাইল কল শিশুদের মস্তিষ্কের হাইপার অ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে- যা পরবর্তী সময়ে একঘণ্টা পর্যন্ত শিশুদের মস্তিষ্কে বিরাজ করে। ফলে এদের মেজাজ খিটখিটে হয়'।

'ঠিক বলেছেন, যে কোনো বিষয়ে ক্রেজি হয়ে যায়'।

\হ'হুম। বাচ্চাদের মোবাইল ব্যবহার কমাতে হবে। তানা হলে আস্তে আস্তে চোখ ড্রাই হয়ে যেতে পারে। এক সময় কালার বস্নাইন্ড হয়ে যাবে। কথা বলতে দেরি হয়। জিদ বেড়ে যায়। স্থূলতা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকলে পারিবারিক সামাজিক আচার শিখে না, শিশু মানবিক হয় না, ওদের নিজস্ব দক্ষতা নষ্ট হয়ে যায়'।

'অন লাইনভিত্তিক লেখাপড়া হয়েছে, এটার কী হবে ডাক্তার সাহেব'?

'করোনা মহামারির সময় লকডাউন শুরু হলে অনলাইনে পড়াশোনা হয়েছে। এখনো চলছে। স্মার্ট হতে গেলে একজন শিশু মোবাইল ব্যবহার করবেই, কিন্তু দেখতে হবে মাত্রাতিরক্ত যেন না হয়।

বাবা মাকেও এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে। নিজেরা বাচ্চাদের সময় দিতে হবে। প্রয়োজনে বাবা-মা নিজেরা মোবাইল ব্যবহার কমিয়ে এনে শিশুদের নিয়ে বেড়ানো, পার্কে যাওয়া, শিক্ষণীয় সফর করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।

'মায়ের ভূমিকা কি হবে? রুপন্তির আম্মু জিজ্ঞেস করলেন।

'মায়ের ভূমিকা অনেক। শিশুকে খাওয়ানে, ঘুম পাড়ানোসহ সব কাজ মায়েরা করেন। ইশারাতেই শিশুর হাতে মোবাইল দিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস করানো যাবে না। টিভিতে কার্টুন দিয়ে খাওয়ানো যাবে না। বাচ্চাদের খেলাধূলায় উৎসাহিত করতে হবে। ক্রিয়েটিভ কাজগুলো শিশুদের দিয়ে করানো যেতে পারে। সপ্তাহে দুইদিন ডিজিটাল ডিভাইসমুক্ত দিন ঘোষণা দিয়ে শিশুদের অন্য কোনো খেলা, কাজে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। মাকেই শিশুরা সবচেয়ে বেশি কাছে পায়, তাই এ ব্যাপারে মায়ের দায়িত্বই বেশি হয়।

'ডাক্তার সাহেব, রুপন্তি মায়োপিয়া থেকে মুক্তি পাবে কি করে'?

'মায়োপিয়ার স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই'।

'কি বলেন, তাহলে'?

'মায়োপিয়া রোগীদের আমরা চশমা দেই'। যে ত্রম্নটির কারণে এটা হয়, সেই প্রতিসরণকারী ত্রম্নটি দূর করতে চশমা কাজ করে। বাচ্চাদের মাঝে মাঝে মোবাইল উপবাস দিতে পারেন'।

'মোবাইল উপবাস আবার কি'?

'এটার মানে হলো মোবাইল থেকে দূরে রাখা। মানে- মাঝে মাঝে বাচ্চাকে মোবাইল দেওয়া স্টপ থাকবে। যত ইলেকট্রনিক ডিভাইস আছে, তা সারাদিন ধরতে পারবে না। তাদের দিয়ে নিজের কাজ নিজে করিয়ে নেওয়ার অভ্যাস গড়তে হবে। নিজের পড়ার বই টেবিলে গোছানো, নিজের কাপড় ধোয়ে ফেলা এসব। তখন মোবাইলে উপবাস চলবে'।

'বুঝেছি ডাক্তার সাহেব। রুপন্তির চশমা ছাড়া আর কি চিকিৎসা দেবেন বা ওর করণীয় কি'?

'রুপন্তিকে ভিটামিন এ, ডি, সি ও ই জাতীয় খাবার দিতে হবে। একটানা অনেকক্ষণ বইপড়া, টিভি দেখা, কম্পিউটারের সামনে থাকা যাবে না। সব সময় চশমা পড়বে। খাওয়ার মধ্যে গাজর, টমেটো, আপেল, মরিচ, সবুজ শাকসবজি ও বাদাম খাবে। কাউন্সিলিং করে বুঝিয়ে মোবাইল কম ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবেন।

এরপর থেকে সারাদিনে একবার মোবাইল পায় রুপন্তি। রুপন্তি অবসর সময়ে ছড়া লিখতে চেষ্টা করে। আজকের শিশুরা আগামী দিনের কান্ডারি হবে। মায়োপিয়াকে জয় করে রুপন্তির মতো লাখো শিশু এগিয়ে যাবে, উঠে যাবে স্বপ্নচূড়ায়। আর এভাবেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে