মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
গল্প

মানবসাই

হঠাৎ আব্রাহাম স্যারের কানে আসে ওদের মধ্যে থেকে কে যেন বলছে, ওকে খেয়ে লাভ নেই, তার চে' ওকে 'মানবসাই' করে রেখে দেই; যাতে আর কোনো মানব আমাদের 'বনসাই' করার সাহস না পায়।'
আশরাফ পিন্টু
  ৩১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

লাইব্রেরিতে বই পড়তে পড়তে 'ইউরেকা!' বলে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে স্বনন। পাশে বন্ধু টমাস নিবিষ্ট মনে বই পড়ছিল। ও স্বননের চেঁচানো দেখে বই থেকে চোখ

তুলে বলে, কী হলো? পাঠাগারে এভাবে কেউ চেঁচায়?

- বন্ধু খুশিতে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। তাই...

-কী এমন আবিষ্কার করলি যে, এভাবে চেঁচিয়ে উঠতে হবে? টমাস টিপ্পনী কাটে।

-আবিষ্কারই বটে! এত দিন যারা এল ডোরাডো শহরের খোঁজ পাইনি আজ এই

পত্রিকায় ডিটেইলস লিখেছে।

-এল ডোরাডো কি?

-তুই একটা বুদ্ধ, খালি পাঠ্যবই নিয়ে পড়ে থাকিস, বাইরের জ্ঞান একেবারেই কম।

এল ডোরাডো হলো একটি প্রাচীন শহরের নাম; যা স্বর্ণের শহর হিসেবে বিখ্যাত। এই শহরের সন্ধান পেতে গত ১০০ বছরে নানা দেশের সংঘটিত অভিযানই হয়েছে অন্তত ১৪টি। এই অভিযানে ইনকা সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেলেও দেখা মেলেনি সেই স্বর্ণ শহরের। ১৯৭১ সালে গহিন জঙ্গলে এমনিভাবে হারিয়ে গেছেন ফরাসি এবং মার্কিন একদল অভিযাত্রী। সম্প্রতি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রত্নতাত্ত্বিকদের মনে করছেন আমাজনের গহিন জঙ্গলের ভেতরে এই শহর অবস্থিত।

-তাতে কি হয়েছে?

-আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই শহরের অভিযানে যাব।

-কি বলছিস এসব? রবিন অবাকচোখে তাকায় স্বননের দিকে।

স্বনন ও টমাস ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। স্বনন পড়ে প্রত্নতত্ত্বে আর টমাস পড়ে উদ্ভিদ আর বনসাই বিভাগে। স্বনন টমাসকে বলে, তোদের ডিপার্টমেন্টের আব্রাহাম স্যার তো খুব ভ্রমণপ্রিয় লোক। তার সঙ্গে আলাপ করে দেখা যেতে পারে।

একদিন শুভক্ষণে আব্রাহাম স্যারকে সঙ্গে নিয়ে স্বনন ও টমাস বেরিয়ে পড়ে এল ডোরাডো শহরের খোঁজে। এল ডোরাডো শহরে যেতে হলে আমাজনের গহিন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অবশ্য আমাজনের জঙ্গলের ভিতরেই এর অবস্থান।

আমাজন জঙ্গলে রয়েছে ১০ লাখেরও অধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। ৮৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। অনিন্দ্য সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিপজ্জনক অনেক প্রাণীই আমাজনে বসবাস করে। এখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং ভয়ংকর সাপ অ্যানাকোন্ডা।

আমাজনে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে- যা প্রায় ১৬ হাজার প্রজাতিতে বিভক্ত।

হরেক রকমের গাছপালা দিয়ে আবৃত এ বনে বেশিরভাগই চিরহরিৎ বৃক্ষ। পৃথিবীজুড়ে যেসব রেইনফরেস্ট রয়েছে তার অর্ধেকটাই এ অরণ্য। তাই একে রেইন ফরেস্টও বলা হয়।

স্বননদের বোট চলছিল একটি নিরাপদ জলপথ দিয়ে। চারপাশে বিচিত্র প্রজাতির নাম না জানা সব বৃক্ষরাজি। মাঝে মাঝে কিছু পরিচিত প্রাণীও দেখা যাচ্ছে, যেমন

ব্যাঙ, বানর ও সাপ ইত্যাদি।

ইঞ্জিনচালিত বোটটি চলতে চলতে একটু গহিন অরণ্যের মধ্যে ঢুকে পড়ে। টমাস একটু ভয় পেয়ে বলে, কোনো হিংস্র প্রাণী নেই তো আশপাশে?

বোটচালক অভয় দিয়ে বলে, না এখানে কোনো হিংস্র প্রাণী নেই। এই গহিন বন পেরুলেই হয় তো দেখা মিলবে এল ডোরাডো শহরের।

বোট চলছে তো চলছেই। চারিদিকে ভ্যাপসা গরম। আদ্র আবহাওয়ায় সবাই ঘেমে নেয়ে উঠেছে। আব্রাহাম স্যার চালককে বোটের গতি ধীর করতে বলেন। বোটটি ধীর গতিতে চলতে থাকে। হঠাৎ 'ঘোঁৎ ঘোঁৎ' শব্দ শুনে আব্রহাম স্যার বোটকে থামাতে বলেন। বোট থেমে গেলে তিনি লক্ষ্য করে একটি বানরকে কোনো প্রাণী যেন জড়িয়ে ধরেছে। গাছের ঘন পাতার কারণে প্রাণীটিকে দেখা যাচ্ছে না। সে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

আব্রাহাম স্যার বলেন, বানরটিকে বোধ হয় কোনো বাঘ-টাগ শিকার করছে।

বোটচালক মাথা নেড়ে জবাব দেয়, না স্যার, ওকে 'প্রাণীখেকো' গাছ ধরেছে।

-বলো কী!

-হঁ্যা স্যার, আমরা ভুল করে 'প্রাণীখেকো' গাছ এলাকায় চলে এসেছি।

এ কথা শুনে টমাস ভয়ার্তস্বরে বলে, চলুন স্যার ফিরে যাই।

স্যার মৃদু হেসে বলেন, ফিরে যাব কেন, বরং আমার একটি গবেষণার উপাদান পেলাম। ভুল পথে এসে ভালোই হয়েছে।

-স্যার, এল ডোরাডোতে যাব না? স্বনন বলে।

-যাব, তবে এখানে একটু কাজ সেরে যাই।

-কি কাজ স্যার?

-আমি তো অনেক বৃক্ষের বনসাই করেছি। কিন্তু 'প্রাণীখেকো' বৃক্ষের তো কোনো বনসাই করতে পারিনি। সুযোগটা যখন এসেই গেল, একে হাতছাড়া

করা ঠিক হবে না।

-না, না, এটা ঠিক হবে না স্যার। এগুলো খুব ভয়ংকর 'প্রাণীখোকো' গাছ।

আপনাদেরও বিপদ হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে বোটচালক চেঁচিয়ে ওঠে।

-'রিস্ক না নিলে গেইনার হওয়া যায় না'; চলো ওর কাছে যাই।

-স্যার, আবার বলছি, যাওয়া ঠিক হবে না।

-আরে এত ভয় পাচ্ছ কেন? চলো।

আব্রাহাম স্যারের কথায় বোটচালক ধীরে ধীরে বোটটি 'প্রাণীখেকো' গাছের কাছে যেতে থাকে। স্বনন ও টমাসও বার বার ওখানে যেতে নিষেধ করে স্যারকে। ওরা ভয়ে কিছুটা জড়সড় হয়ে বোটচালকের গা ঘেঁষে বসে থাকে। স্যার বোটের সামনে বসে গাছগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার স্যার বোটচালককে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় কে যেন পেছন থেকে পেঁচিয়ে ধরে বোট থেকে শূন্যে তুলে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে যেতে থাকে 'প্রাণীখেকো' গাছের সারির ভেতরে।

আব্রাহাম স্যার বুঝতে পারে 'প্রাণীখেকো' গাছের হাতে ধরা পড়েছে সে। এ থেকে আর নিস্তার নেই, তাকেও ওদের পেটের ভেতরে যেতে হবে।

হঠাৎ আব্রাহাম স্যারের কানে আসে ওদের মধ্যে থেকে কে যেন বলছে, ওকে খেয়ে লাভ নেই, তার চে' ওকে 'মানবসাই' করে রেখে দেই; যাতে আর কোনো মানব আমাদের 'বনসাই' করার সাহস না পায়।'

আব্রাহাম স্যারকে কীভাবে উদ্ধার করবে স্বনন আর টমাস ভেবে পায় না। বরং তারা নিরাপদ দূরত্ব থেকে নিরুপায় হয়ে দেখতে থাকে- আব্রাহাম স্যারের দেহ ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে