রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন ও শৃঙ্খলা আনয়নে আইনের প্রয়োগ

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিমুক্ত করতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সংকট মোকাবিলায় যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা কাটাতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জোরদার ও তদারকি চালিয়ে যেতে হবে। সঠিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে যেমন ডিপোজিট বাড়াতে হবে, তেমনি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশও গড়ে তুলতে হবে। বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

ব্যাংকিং খাত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমানতকারী তথা সাধারণ জনগণের অর্থ দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি ঋণের মাধ্যমে আত্মসাৎ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন সংক্রান্তে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩ এর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়, কেউ খেলাপি হলে অন্য কোনো ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিতে পারবে না। ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের সংখ্যা কমানো হয়েছে।

কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একটি পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ তিনজন পরিচালক হতে পারবেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ খেলাপি হলে তিনি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে। ঋণের অর্থ পরিশোধ করলেও তিনি পরবর্তী পাঁচ বছর আর পরিচালক হতে পারবেন না। ঋণখেলাপিরা দেশের বাইরে যেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে।

এ আইনে 'ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা'র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যিনি নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে, নামে-বেনামে বা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করবেন না, তাকেই বলা হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন-২০২৩ এ অধিকার ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে 'ব্যাংক' শব্দ ব্যবহারের অপরাধে সর্বোচ্চ সাত বছর বা ৫০ লাখ টাকা দন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এমন বিধানও অন্তর্ভুক্ত আছে।

আইনে আরও বলা হয়, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক এরূপ বিবেচনা করে যে, কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান জ্ঞাতসারে বা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিধান লঙ্ঘন করছে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানকে নূ্যনতম ৫০ লাখ টাকা বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ বিধান লঙ্ঘন চলমান থাকলে প্রথম দিনের পর প্রতিদিন এক লাখ টাকা হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে।

ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।

আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশ প্রাপ্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং রাখার বিধান প্রণয়ন করতে হবে। বারবার পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।

ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি করতে হবে; প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ করতে হবে; পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সীমিত হলেও পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে।

তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ১০টি সুপারিশ টিআইবি প্রদান করে।

দেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস মহামারির নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় এক সার্কুলারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, ১ জানুয়ারি, ২০২০ ঋণের শ্রেণিমান যা ছিল, ৩০ জুন, ২০২০ পর্যন্ত সময়ে ওই ঋণ তার চেয়ে বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। পরে ১৫ জুন এ সংক্রান্ত অপর একটি সার্কুলারে বলা হয়, ১ জানুয়ারি, ২০২০ তারিখে ঋণ/বিনিয়োগের শ্রেণিমান যা ছিল, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত ওই ঋণ/বিনিয়োগ তার চেয়ে বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না।

তবে কোনো ঋণের/বিনিয়োগের শ্রেণিমানের উন্নতি হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণিকরণ করা যাবে। সে বছর ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত আরেকটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের কোনো কিস্তি পরিশোধ না করলেও গ্রহীতা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন না। সে সময়ের মধ্যে ঋণ/বিনিয়োগের ওপর কোনোরকম দন্ড, সুদ বা অতিরিক্ত ফি (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) আরওপ করা যাবে না।

শুধু করোনাকালেই নয়, এর পরেও অদ্যাবধি বিভিন্ন সময়ে ঋণ পুনর্গঠন, ঋণ পুনঃতফসিল ও ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে এ সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বটে- তবে এতে কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি, বরং এসব পদক্ষেপ খেলাপি ঋণ আদায় প্রক্রিয়াকে আরও প্রলম্বিত করেছে। তাই খেলাপি ঋণসহ ব্যাংকিং খাতে সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

ঋণ খেলাপিরা যাতে প্রতারণা ও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে আইনে সে ব্যবস্থার পাশাপাশি ঋণ বা বিনিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকেও স্বচ্ছতার এবং জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। জনগণের অর্থ লুণ্ঠনের যুগে যুগে চলে আসা ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে রুখতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাপক বাধাগ্রস্ত হবে।

হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-১৮৮১ ও অর্থঋণ আদালত আইন-২০০কে আরও গতিশীল ও যুগোপযোগী করতে হবে। ভদ্রবেশী ঋণখেলাপিদের হাতে যাতে দরিদ্র জনগণের অর্থ না যায় তার জন্য সচেতন থাকতে হবে। এ সমস্যা সমাধানে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারসহ পর্যবেক্ষক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকৃত সৎ, পরিশ্রমী, মেধাবী ও যোগ্য ব্যবসায়ী/শিল্পপতিদের প্রয়োজনীয় ঋণ/বিনিয়োগ সুবিধাসহ প্রণোদনা ও উৎসাহ প্রদান করতে হবে। ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবকৃত জামানত বা সম্পত্তির প্রকৃতি যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

সম্পত্তি কারো কাছে দায়বদ্ধ আছে কিনা বা পূর্বে কোথাও বন্ধক প্রদান করেছে কিনা তা সংবাদ পত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের মাধ্যমে যাচাই করা জরুরি। ওই সম্পত্তি সংক্রান্তে আর,এস রেকর্ডীয় মালিক হতে স্বত্বের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দেখতে হবে। স্বত্বের ধারাবাহিকতার সংশ্লিষ্ট সব বায়া দলিল, আর,এস খতিয়ান, বি,এস খতিয়ান, দায়মুক্ত সনদ, বি,এস নামজারি খতিয়ান, ডিসিআর, হালসন খাজনা পরিশোধের দাখিলা, সিডিএ/রাজউক অনুমোদন পত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), হাউজিং সোসাইটির পস্নটের ক্ষেত্রে এনওসি বা অনুমতি পত্র, সার্ভে রিপোট বা আর,এস দাগের সঙ্গে বি,এস দাগ মিলামিল সংক্রান্ত সংবাদের দরখাস্ত ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট খতিয়ান সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট এ.সি (ল্যান্ড)/ সংশ্লিষ্ট কালেক্টরেটের রেকর্ডরুমে তলস্নাশিক্রমে সঠিক আছে কিনা যাচাই করে দেখতে হবে। জমির স্কেচ ও চৌহদ্দি নির্ধারণসহ তফসিলভুক্ত সম্পত্তিতে মালিকের সরেজমিন পৃথক চিহ্নিত মতে বাস্তব দখল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

খেলাপি ঋণের কারণ এবং তা কমিয়ে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তা খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতা নির্বাচনে দুর্বলতা, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের অপর্যাপ্ততা, অতিমূল্যায়ন ও ঝুঁকি বিশ্লেষণে দুর্বলতা, এক ব্যাংক কর্তৃক অন্য ব্যাংকের খারাপ ঋণ অধিগ্রহণ, চলতি মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ না করা, একাধিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান, শাখা পর্যায়ে ঋণ প্রদানের ক্ষমতা সীমিতকরণ, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহার খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ।

পরিশেষে বলব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিমুক্ত করতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সংকট মোকাবিলায় যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা কাটাতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জোরদার ও তদারকি চালিয়ে যেতে হবে। সঠিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে যেমন ডিপোজিট বাড়াতে হবে, তেমনি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশও গড়ে তুলতে হবে। বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যাচাই-বাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে