শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যয় কমাতে সাক্ষী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও করণীয়

মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যয় কমাতে সাক্ষী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও করণীয়

তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব

মামলার ২৪ বছর পর প্রথম দু'জন সাক্ষী আদালতে এসেছেন। উভয় সাক্ষীই আদালতে এসে বললেন, তারা মামলা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। কে বাদী কে আসামি জানেন না।

কেন তারা সাক্ষী হয়েছেন তাও জানেন না। সাক্ষীদের এমন বক্তব্যে আমি মোটেও অবাক হইনি। কেননা, মাদক ও নিষিদ্ধ দ্রব্য উদ্ধারের মামলায় জব্দ তালিকায় প্রায় সব সাক্ষীই এরূপ বক্তব্য প্রদান করে। এ সংক্রান্তে উচ্চ আদালতের অসংখ্য রায়ের মাধ্যমে কিছু সাবধানতার নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- যা অধস্তন আদালতে অনুসরণ করা হয়। অত্যাশ্চার্য হয়েছি, গত ২৪ বছরে কোনো সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হয়নি দেখে।

মামলার ঘটনাটি পড়ছিলাম গত বছর দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে। ১৯৯৮ সালে রাজশাহীর এক কৃষক তার বাড়ি থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দূরে কোনো এক জেলার বাস-টামিনালে পুলিশ কর্তৃক ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক হন। পুলিশ তদন্ত করে ০৬ মাস পর অভিযোগ পত্র দিলেও অভিযোগ গঠনের পর কোনো সাক্ষী আদালতে আসেনি। মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে কোনো সাক্ষী আসেনি। এ যেন আসামির এক অন্তহীন পথযাত্রা। এমন পথযাত্রায় তার মতো অনেকে মামলার ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হয়ে বিক্রি করেছেন জায়গা-জমি, হারিয়েছেন অর্থ-সম্পদ ও জীবনী শক্তি।

মূলত, সাক্ষীব্যবস্থাপনার ত্রম্নটি এই দীর্ঘসূত্রিতা ও ভোগান্তির অন্যতম প্রধান কারণ।

আমাদের দেশের ফৌজদারি বিচারিক আদালতগুলোতে ২৪ বছরের এমন পুরনো মামলা খুব কমই আছে। তবে ১০ বছরের অধিক পুরনো মামলা নেহাতই কম নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৪ লাখ

ফৌজদারি মামলা রয়েছে (দ্য ডেইলি স্টার, বাংলা অনলাইন, ১ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৩)। যারা ফৌজদারি বিচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন তারা জানেন, এই মামলাসমূহের মধ্যে অধিকাংশ মামলাই মাদকের এবং কারাগারে অধিকাংশ আসামিও আছে মাদক সংশ্লিষ্ট মামলায় (দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ অক্টোবর, ২০২১)। তারা কেউ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে, কেউ স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে কিংবা অন্য কোনো মাদক সংশ্লিষ্ট মামলায় জড়িত আছে।

একটু সচেতনভাবে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এই মামলাগুলোর ৯০ শতাংশ সাক্ষীই সরকারি সাক্ষী। পুলিশ,র্ যাব, বিজিবি বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই এ সব মামলার এজাহারকারী হয় এবং তাদের সঙ্গীয় সদস্যরা অভিযানকারী দলের সদস্য হিসেবে সাক্ষী হন। এছাড়া স্থানীয় দু'জন সাক্ষী থাকে যারা তলস্নাশির সময় অভিযানকালে উপস্থিত থাকেন।

নিবিড়ভাবে মামলাগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, যে বা যারা মামলাগুলোর এজাহারকারী, সঙ্গীয় ফোর্স বা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হন, তিনি একই থানার অন্য মামলার এজাহারকারী, সঙ্গীয় ফোর্স বা তদন্তকারী কর্মকর্তা হন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন কর্মকর্তা তার কর্মস্থলে এরূপ শুধু একটি মামলার অভিযান পরিচালনা করেন না, তার ৩/৪ বছরের কর্মকালীন সময়ে তিনি এরূপ শতাধিক মামলায় তিনি কখনও এজাহারকারী, সঙ্গীয় ফোর্স বা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

এছাড়া হত্যা, ধর্ষণসহ অন্যান্য ফৌজদারি মামলাতেও চিকিৎসক সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রমুখ সরকারি সাক্ষীর জন্য বছরের পর বছর পড়ে থাকে। এই মামলাগুলো একই জেলার বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এমন নজির আছে যে, সাক্ষী পাশের আদালতে ভিন্ন জেলা থেকে এসে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন তাকে আরেক আদালতে বছরের পর বছরও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই মামলাগুলোর সাক্ষী পরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করলে অধিকাংশ মামলাই বিশ বছরে নয় বরং এক বছরেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।

যদি মামলাগুলোকে সাক্ষী অনুসারে পৃথক করে একই দিনে কয়েকটি বা পরপর তারিখ রাখা যায় তাহলে সহজেই সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যাবে এবং সাক্ষ্য গ্রহণ অন্তে দ্রম্নত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। যে সাক্ষী পঞ্চগড় আদালতে কক্সবাজারের মতো দূরবর্তী জেলা থেকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আসবে, তাকে একই আদালতে বা ওই জেলার অন্য আদালতে ০৭ দিন পর আনা সম্ভব নয়। এটা বাস্তবসম্মত নয়।

কিন্তু তথ্য সংগ্রহ করলে দেখা যাবে, একই ব্যক্তি বিভিন্ন আদালতে ওই মাসে ৭/৮টি মামলায় সাক্ষী আছে। এই সাক্ষীকে এক মাসে ৭/৮ দিন কক্সবাজার থেকে আনা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই তিনি ওই মাসে অন্যান্য আদালতের মামলাগুলোতে আসতে পারেন না। আবার তিনি যদি সেখান থেকে বদলি হন তবে তাকে খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন হয়ে যায়। কেননা, আদালত থেকে সমন দেবে পুলিশ সুপারের মাধ্যমে তার অভিযোগপত্রে বর্ণিত ঠিকানায়। এই সাক্ষী যদি জেলায় কর্মরত থাকেন তবে সহজেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। যদি রেঞ্জের মধ্যে থাকে তবে ডিআইজির মাধ্যমেও তাকে পাওয়া যায়। কিন্তু রেঞ্জ পরিবর্তন হয়ে গেলে তার কাছে বার্তা পৌঁছাতে পৌঁছাতে আদালতে নির্ধারিত সাক্ষ্য প্রদানের তারিখ অতিবাহিত হয়ে যায়। যদিও সম্প্রতি অধিকাংশ মামলাতেই সাক্ষীদের মোবাইল নম্বর অভিযোগপত্রে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই নম্বরগুলো সরকারি নম্বর নয়। কোনোটাতে হোয়াটস অ্যাপ আছে, কোনোটাতে নেই। কিন্তু আজ থেকে ৪/৫ বছর আগের মামলাগুলোতেও সাক্ষীদের মোবাইল নম্বর অভিযোগপত্রে নেই। এই সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করাটা পুলিশের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বটে।

এরূপ ক্ষেত্রে চমৎকার সমাধান হতে পারে যদি আমরা সাক্ষী ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত একটি সফটওয়্যার বা অ্যাপস ব্যবহার করি। যেমন, এসআই মামুনুর রশিদকে আদালত থেকে সমন দেওয়ার প্রয়োজন হলো। তার নাম, বিপি নম্বর বা মোবাইল নম্বর দিয়ে অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে ওই সাক্ষীর ওই জেলায় কবে কবে সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য আছে। আবার তিনি সমনের হার্ডকপির পাশাপাশি মোবাইলে তাৎক্ষণিকভাবে মেসেজ পাবেন এবং ওই মেসেজ তিনি দেখেছেন কিনা তা লাল/সবুজ বিশেষ রং দ্বারা চিহ্নিত করা থাকবে। ফলে সংশ্লিষ্ট আদালত সহজেই সেই নির্ধারিত তারিখে বা তার সামনে বা পেছনে তারিখে সমন্বয় করে দিন ধার্য করতে পারবেন।

এভাবে ওই সাক্ষী সেই জেলায় একবার এসে এক সপ্তাহ থেকেই ১৫-২০টি মামলায় সাক্ষ্য দিতে পারবেন। কিন্তু একই সাক্ষী ওই ১৫-২০টি মামলার জন্য দূরবর্তী জেলা থেকে আসতে হলে প্রতিবার আসা যাওয়া বাবদ তিন দিন করে মোট ৪৫-৬০ দিন সময় ব্যয় হতো। একইসঙ্গে টিএ/ডিএ বাবদ সরকারি ব্যয় বাড়তো। কিন্তু বর্ণিত পদ্ধতিতে শুধু একবার এসেই একজন সাক্ষীর জন্য সাক্ষী ব্যবস্থাপনায় সরকারের লক্ষাধিক টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। সাক্ষী অনুসারে মামলা পৃথক করা হলে দূরবর্তী সাক্ষীদের ক্ষেত্রে একই কাজ আমরা হাইকোর্টের প্রাকটিস নির্দেশনা অনুসরণ করে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে তা করতে পারি। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট সরকারি সাক্ষী বেচে যাওয়া সময় অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবেন।

আদালতে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অধিকাংশ মামলাতে অপ্রয়োজনীয় সাক্ষীর নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এক মামলাতে ২০-২৫ জন সাক্ষীর নাম থাকলে সব সাক্ষী পরীক্ষা করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়। শুধু তাই নয়, ঘটনার সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিকেও সাক্ষী করা হয়। নাম-ঠিকানা যাচাইকারী পুলিশ কর্মকর্তা, রেকর্ডিং অফিসার, একই মামলায় ৪/৫ জন তদন্তকারী কর্মকর্তার নাম যাদের অধিকাংশ জনের মামলার তদন্তে কোনো ভূমিকা থাকে না, শুধু বদলিসূত্রে দায়িত্ব পেয়েছিলেন এমন অপ্রয়োজনীয় সাক্ষীর নাম অভিযোগপত্রে পাওয়া যায়। আমরা সাক্ষ্য আইনের বিধান ভুলে যাই যে, কোনো নির্দিষ্ট বিষয় প্রমাণের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সচেতন হতে হবে।

এছাড়া মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করেছি, ভুল সরকারি সাক্ষী আদালতে আসেন। আদালত থেকে অভিযোগপত্রে বর্ণিতরূপে সমন/ওয়ারেন্ট দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে ভুল মেসেজ দেওয়ার কারণে দূরদূরান্ত থেকে সরকারি সাক্ষী এসে ফেরত যায়। এমন সাক্ষীও পেয়েছি- যারা ঘটনার সময়ে ওই থানায় কর্মরত ছিলেন না। এর কারণ মূলত দুইটি। যথা-১. সমনে সাক্ষীর ব্যক্তিগত শনাক্তকারী নম্বর বা সার্ভিস আইডি ও মোবাইল নম্বর না থাকা ও ২. ওই জেলায় সংশ্লিষ্ট সাক্ষীর পরিবার থাকায় তিনি মেসেজ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বা আদালত কর্মচারীদের সঙ্গে যোগশাজস করে এরূপ সমন নেয়। তবে আদালত কর্মচারীদের ভুলেও সঠিক সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জেরা গৃহীত হওয়ার পরেও রিকল করা ছাড়াই আসতে পারেন যদি না পূর্বে সাক্ষ্য দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মচারী তার নামটি অভিযোগপত্র হতে বিশেষ চিহ্ন দ্বারা না কাটেন।

আরেকটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে, সাক্ষীরা আদালতে এসে তাদের তদন্তকালীন সময়ে প্রদত্ত জবানবন্দি খুঁজে পায় না। কেস ডায়েরি বা সিডি পাওয়া যায় না। প্রসিকিউটরদের অব্যবস্থাপনায় সরকারি সাক্ষীরা নথি দেখার সুযোগ পেলেও পাবলিক সাক্ষীরা তা পায় না। ফলে তারা সাক্ষ্য আইনের ১৫৯ ধারায় বিধান মতে তাদের স্মৃতি পুনরুজ্জীবিতও করতে পারেন না। তাই মানসম্মত ও সতেজ সাক্ষ্য প্রদানের জন্য সিডি সংরক্ষণ অপরিহার্য।

মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চিফ

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে