শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লেখক গবেষক সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ

সালাম সালেহ উদদীন
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

নিজস্ব সাধনায় লেখালেখিতে যারা সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন, পেয়েছেন পেশাগত ও পাঠকখ্যাতি তাদের একজন সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি এদেশের খ্যাতিমান কলামিস্ট, গবেষক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা করেছেন, লিখেছেন অজস্র লেখা। তার লেখার মধ্যে উঠে এসেছে সমসাময়িক সমাজের কঠিন বাস্তবতা। তিনি ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দল তোষণে বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।

বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন। যা দেশের যোদ্ধামহলে সমাদৃত হয়েছে। পাশাপাশি কাব্যচর্চাও করেছেন তিনি। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা চলিস্নশের ওপর। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বেসরকারি পর্যায়েও তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

তার সঙ্গে আমার পরিচয় নব্বই দশকের শুরুর দিকে, যখন আমি দৈনিক আজকের কাগজে যোগদান করি। আমি সাহিত্য ও সম্পাদকীয় পাতার দায়িত্বে ছিলাম। তিনি উভয় বিভাগেই নিয়মিত লিখতেন। ১৯৯৬ সালের কথা, মকসুদ ভাইয়ের ৫০তম জন্মদিন। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন সাহিত্যের পাতায় তার কভারেজ দিতে। আমি তার সাক্ষাৎকার নিলাম। পাশাপাশি তার নিজের লেখাও প্রকাশিত হলো। লেখা বাহুল্য, তখনো তিনি খ্যাতি অর্জন করেননি লেখালেখি, সভা-সেমিনার ও টেলিভিশনের টকশোর মাধ্যমে। তার জন্মদিনের কভারেজ দিতে গিয়ে আমাকে রোষানলে পড়তে হয়, চাকরির ওপর ঝুঁকি আসে। তবুও আমি দমে কিংবা থেমে থাকিনি। তার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে আগের মতোই। তিনি যেমন আজকের কাগজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসতেন, একইভাবে আসতেন যায়যায়দিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও। তিনি যায়যায়দিনেও কলাম লিখেছেন, লিখেছেন বিশেষ সংখ্যায়ও। তিনি আমার লেখালেখির উত্তরণে সন্তুষ্ট হলেও, পেশাগত উত্তরণ চেয়েছিলেন, তার মতো করে। তিনি বলতেন এক জায়গায় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা নাকি আমার অভ্যাস। তিনি যায়যায়দিনে প্রকাশিত আমার কলাম নিয়মিত পড়তেন, মতামতও জানাতেন। মিতাকে নিয়ে তার এলিফ্যানট রোডের বাসায়, পরে ধানমন্ডির বাসায় বহুদিন গিয়েছি। ১৫ বছর আগে তাকে দোহার নিয়ে গিয়েছিলাম এক অনুষ্ঠানে। তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি, আমি বিশেষ অতিথি। যাতায়াতের সময় তার সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি নানা বিষয়ে কথা হয়। তার চিন্তা খুবই পরিশীলিত ও অধুনিক। যা প্রতিফলন তার বিভিন্ন লেখায় পেয়েছি। তিনি পত্রিকায় যে কলাম লিখতেন, তা নিছক কলাম নয়, তার ভাষাভঙ্গি ও তথ্য-উপাত্তের সমাহার লেখাকে অনন্যতা দিত। লেখালেখি ও গবেষণায় তিনি কখনো ফাঁকি দিতেন না। যার কারণে পাঠকমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। তিনি সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর জীবন ও সাহিত্য বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এটি একটি অসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ। তার বই পাঠে অনুপ্রাণিত হয়ে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর ওপর প্রবন্ধ লিখেছিলাম। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক এমন বই লিখতে পারবেন কিনা আমার সন্দেহ।

তিনি ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ও মা সালেহা বেগম। শৈশব থেকে আবুল মকসুদ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকাপাঠের সুযোগ পান।

সৈয়দ আবুল মকসুদের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। এটি ছিল পাকিস্তান সোশ্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থিত সাপ্তাহিক 'জনতা'য় কাজ করেন কিছুদিন। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বার্তা সংস্থায় যোগ দেন। ২০০৮ সালের ২ মার্চ বার্তা সংস্থার সম্পাদকীয় বিভাগের চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি দৈনিক প্রথম আলোর একজন নিয়মিত কলামিস্ট ছিলেন। এই দৈনিকে 'সহজিয়া কড়চা' এবং 'বাঘা তেঁতুল' শিরোনামে তিনি সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কলাম লিখতেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ দেশের রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিসহ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদপত্রে কলাম লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাজ রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, ব্যক্তি পর্যায়েও হয়। তবে তার পতিবাদ ছিল অন্যরকম। তিনি আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণের প্রতিবাদে, সেলাইবিহীন সাদা পোশাক ধারণ করেছিলেন আমৃতু্য। মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সামাজিক অন্যায় অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ সত্যিই অভিনব।

আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ভিন্ন মতকে গ্রহণ করার উদারতা এখনো অর্জন করেনি। যারা ভিন্ন মত প্রকাশ করেন, তাদের ওপর অত্যাচার নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে। বাসসে চাকরিকালীন তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখতেন। তৎকালীন সরকার এটা পছন্দ করেনি। তাই তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর লেখালেখিকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন। সত্যবাদিতা ন্যায়নিষ্ঠা এবং সাহসী উচ্চারণের জন্য তিনি আমাদের স্মৃতিতে উদাহরণ হয়ে থাকবেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন। কবিতার পাশাপাশি তার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার বইয়ের মধ্যে রয়েছে প্রবন্ধগ্রন্থ : যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা, গান্ধী, নেহেরু ও নোয়াখালী, ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, প্রতীচ্য প্রতিভা, কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, অরণ্য বেতার, বাঙালি জাতি বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতি, রবীন্দ্র রাজনীতি, নির্বাচিত প্রবন্ধ। জীবনীগ্রন্থ : মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবন-কর্মকান্ড-রাজনীতি ও দর্শন, সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর জীবন ও সাহিত্য, ভাসানী কাহিনী, স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ, গান্ধী মিশন ডায়েরি, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ দার্শনিক, পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রুন্নেসা খাতুন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী জীবন ও সাহিত্য, হরিশচন্দ্র মিত্র। কাব্যগ্রন্থ : বিকেলবেলা, দারাশিকো ও অন্যান্য কবিতা ও সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা।

তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের সমার্থক একজন মানুষ। যিনি একদিকে শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, আবার ইতিহাস ও জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন শাখায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন সক্রিয়ভাবে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। মানবতাবাদকে তিনি জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। নির্মোহভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতেন সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজের নানা অসঙ্গতি। যে কোনো অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রাজপথে নেমে আসতেন। মৌলবাদ-সাম্প্র্রদায়িকতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দীর্ঘ দিন সামনের সারিতে ছিলেন তিনি। তিনি সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গেছেন।

গান্ধীবাদী হিসেবে পরিচিত দেশের খ্যাতিমান এই লেখক হঠাৎ করেই চিরতরে চলে গেলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। আসলে একজন দীর্ঘ সাধকের জীবনাবসান হলো। সেই যৌবন থেকে শুরু করে মৃতু্যর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি একইভাবে গবেষণা চালিয়ে গেছেন, সাধনা করেছেন জ্ঞানের। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চার দিকপাল। তিনি গবেষণা, জ্ঞানচর্চা একইভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সাধারণত গবেষণা হয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে; কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদ গবেষণার ক্ষেত্রেও নিজেকে এক অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। নিজের মেধা যোগ্যতা সাধনা ও কর্মদক্ষতায় নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। দেশের যেখানেই মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা চলেছে তিনি সেখানেই ছুটে গিয়েছেন। এ দেশের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলন এবং ইতিহাসের বাঁক বদলের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ও অবদান জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণে রাখবে। তিনি তার কাজের মাধ্যমে মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে নিজেকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যা নতুন প্রজন্মের কাছে ধ্রম্নবতারার মতো। তিনি সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করেছেন সব সময় এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। তার প্রজ্ঞার দৃষ্টি এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন যে, তা সমাজে আলো ফেলেছে। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্যে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে