শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংশয়

নূরনাহার নিপা
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

দীপ্ত হন্তদন্ত করে চেরাগি মোড়ের দিকে দ্রম্নত হাঁটতে লাগল। ধুর দেরি হয়ে গেল বোধ হয়।

এতক্ষণে ইসান বাতিঘরে এসে অপেক্ষা করছে।

কি মনে করবে ইসান! প্রয়োজনটা আমার নিজের, অথচ সে এসে অপেক্ষা করছে! ইসানের সঙ্গে দেখা করে এবার যদি কিছু একটা করতে পারি।

তাহলে অনেক ভালো হতো। ইসান এখন বিদেশে করপোরেটে জব পেয়েছে। জীবনে কত ইন্টারভিউ দিলাম কিছু তো হলো না।

বাবা স্ট্রোক করে মারা যান। বাবা চলে যাওয়ার পর বড় অসহায় হয়ে গেলাম। বাবা খুব ভালো কবিতা লিখতে পারতেন। বাবার সৃজনশীল স্মৃতি রেখে গেছেন কবিতার বইটি। পাশাপাশি রেখে গেছেন আরও কিছু স্মৃতি। বাবার স্মৃতিগুলো আমার বুকের ভেতর শোকের বাগান হয়ে আছে।

প্রতিদিন টিউশন শেষে আসতে আসতে দীপ্তর রাত হয়ে যায়। দু'চোখ যেন ঘুমকাতুরে হয়। বিছানাটাতে খোঁজে একটু আশ্রয়।

বাবা থাকতে তেমন কোনো চিন্তা ছিল না।

আজ বাবা নেই, তাই সব দায়িত্ব কর্তব্য দীপ্তর মাথার ওপর পড়েছে। অবিবাহিত বোন, অসুস্থ মা, ছোট ভাই-বোনের পড়ার খরচ। সব এখন দীপ্তকে ব্যবস্থা করতে হয়।

বাবাকে কবি হিসেবে অনেকে সম্মান করত? এরপর হয়তো তাকে অনেকে ভুলে যাবে। বাবার কবিতার বইটি বাবাকে বাঁচিয়ে রাখবে কি না সেটা অন্য কথা। অকালে চলে যাওয়ার পেছনে কারণ কী? আমরা সেটা ভাবছি। তার অসুস্থতার চিকিৎসা করার কথা কেউ কর্তব্যের বলে মনে করিনি শুধু এক দিন শোক-শ্রদ্ধা জানিয়েই ক্ষান্ত দিয়েছে বিষয়টাকে। আমরা ভাবছি এই মৃতু্যর দায় সমাজ ব্যবস্থার।

সমাজের উচ্চ শ্রেণির কর্তারা তার প্রতি সামান্য দয়াপরবশত হলে হয়তো অকালে একটা প্রাণ হারিয়ে যেত না। কেউ কেউ ভাবতে পারেন সে আর মহান কে? মরলেই কী আর বাঁচলেই কী! এটা হয়তো ঠিক তিনি মহান কেউ হতে পারেননি। তার মাঝে ছিল সততা, তিনি নিজের চেয়ে দেশকে ভালোবাসতেন, দেশের মানুষের কথা ভাবতেন রাজনৈতিক জীবনে কি সততার কোনো মূল্য আছে! কোনো মহৎ কিছু পায়নি। যারা দুর্নীতি করেছে তারা সমাজে বিত্তমান।

তবে তার মাঝে যা ছিল অসম্ভব সম্ভাবনা। আমরা কি তার সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করতে পারি? নিশ্চয় পারি না। বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি আমাদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারতেন। মৃতু্যর মধ্যে দিয়ে এমন আফসোস রেখে গেলেন।

\হএই আফসোসটা হয়তো সবাইকে নাড়া দেবে না, কাউকে কাউকে নাড়া দেবে যারা বাবাকে ভালোবাসতেন। দীপ্ত বাবার মতো কবিতা লিখে, ইদানীং বেশ পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে। কবিতা লিখে কি আর পেটের খিদা মিটে। একটা চাকরির জন্য কত চেষ্টা মাঝেমধ্যে ভীষণ উদাসীন মনে হয়।

দীপ্তকে।

\হকবিতা লেখার পাশাপাশি বাংলাদেশ তারণ্য প্রতীক শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। এটা প্রগতিশীল একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন। তারুণ্যের প্রতীক করার জন্য একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে হয়তো প্রচুর বাহবা পেয়েছে। কিন্তু বাহবায় কি আর পেট ভরে? পেট এসব বাহবা-টাহবা চায় না। চায় ভাত। ভাত জোটানোর চূড়ান্ত লড়াই করেছেন তিনি। প্রগতির লড়াইয়ে তার সঙ্গী হয়তো অনেকে ছিলেন। ভাত জোটানোর লড়াইয়ে ক'জন ছিলেন সেটাই ভাববার বিষয়। কবি-লেখক হিসেবে উচ্চপর্যায়ে চাকরি করেন এমন কবি সাহিত্যিকদের কাছেই বেশি ঘুরেছেন চাকরির জন্য। তার বিশ্বাস ছিল, অন্তত কবি সাহিত্যিকরা তার প্রতি বিমুখ হবেন না, দয়াপরবশত হবেন। তার বিশ্বাস চূর্ণ হয়েছে বারবার। কেউ কেউ তাকে পাত্তা দিলেও চাকরি দিতে পারেননি। আবার কেউ কেউ পাত্তাই দেননি। এড়িয়ে গেছেন চূড়ান্তভাবে। বড় একটা করপোরেট অফিসের কর্তা, বড় সাহিত্যিক তাকে অফিসে যেতে বলেছিলেন। অফিসে গেলে কথা বলার আদবটুকুও দেখাননি হীন এই সাহিত্যিক। অথচ দীপ্ত খুব আশা নিয়ে গিয়েছিল তার কাছে। ভেবেছিল চাকরি হয়ে যাবে নিশ্চিত। চাকরি দেওয়ার মতো ক্ষমতা ওই সাহিত্যিকের ছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হলো দীপ্তকে। এভাবেই তাকে বিষিয়ে তুলছিল আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। অর্থকষ্ট, বেকার থাকার বিষণ্নতা। এসবের চাপ থেকেই হয়তো স্ট্রোক হয়। যার পরিণতি মৃতু্য।

অথচ আমাদের কবি সাহিত্যিকরা সমাজ বদলানোর দায় কাঁধে নিয়ে লিখতে আসেন। নানান নীতিকথা শোনান। সমাজ বদলানোর কত প্রয়াস যে তাদের মধ্যে পাওয়া যায় তার সীমারেখা নেই। তারা দীপ্তকে একটা চাকরির ব্যবস্থা বা বাঁচার অবলম্বন করে দেওয়াকে সমাজ বদলানোর অংশ মনে করেননি। এই হলো কবি সাহিত্যিকদের মানসিকতা।

আমাদের এমপি-মন্ত্রী তথাকথিত জনদরদিরা মুখে উন্নয়নের ফেনা তোলেন। বাংলাদেশকে ইউরোপ-আমেরিকা-সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করেন। দেশে যে দীপ্তরা ধুঁকে ধুঁকে মরছেন তারা কি দেখেন না বা জানেন না? দেখেন এবং জানেনও। কিন্তু এসবে তাদের ন্যূনতম টনক নড়ে না। তারা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চিন্তায়ই দিন পার করেন। উন্নয়নের তুলনাটা হয়তো উপমা হিসেবে ব্যবহার করেন কবি হওয়ার খায়েশ থেকে। এমপি-মন্ত্রী হয়ে বিরাট লাটসাহেব হয়েছেন এখন কবি হবেন বৈকি!

বাবার মৃতু্যর দায় এসব এমপি-মন্ত্রী লাটসাহেবদের তথা এ সমাজ ব্যবস্থার। এই সমাজ ব্যবস্থা আরও অসংখ্য মানুষকে মৃতু্যর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং দেবে। অথচ সামান্য ভূমিকা নিলে হয়তো বাবাকে অকালে প্রয়াত হতে হতো না। এই সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন জরুরি। সমাজের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। নইলে আরও অসংখ্য দীপ্তকে এভাবে রাস্তার ধারে পেটের খিদা নিয়ে হারিয়ে যেতে হবে।

দীপ্ত খুব ভালো গান করে। তার বাবা গানের শিক্ষক। এলাকায় ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন। এটাই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। এর বাইরে তাদের সহায় সম্পত্তি নেই, বাঁচার কোনো অবলম্বন নেই। মৃতু্যর আগ থেকেই অসুস্থ ছিলেন। এখন কে ধরবে সংসারের হাল? কী হবে তাদের? এখন তারা কি শোকে মারা যাবেন না কী অনাহারে? আদতে শোকে মানুষ মরে না। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় বটে। গস্নানি নামের ছালা টেনে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকে, বাঁচতে হয় বলেই। এই করুণ সময়ে পরিবারের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। এই দেশে হাজারো তরুণদের বেকার হতাশা গ্রাস করে, প্রতিটি মুহূর্ত একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করে।

নয়তো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ভুল প্রমাণিত হবে। ভুল প্রমাণিত হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। ব্যর্থ হয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে