রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্য

মাসুদুজ্জামান
  ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০
জোয়াকিম মারিয়া মাচাদো দো আসিস দম কাসমুরো

পর্ব ৪

সামাজিক প্রতিবাদ বলতে ঔপন্যাসিক ক্লোরিন্দা মাতো দা টার্নারের 'স্বদেশী' (ইনডিজেনাস) মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর প্রভাবশালীদের (চার্চ, সরকার ও ভূস্বামী) প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশকেই ঔপন্যাসিকের মতাদর্শিক অবস্থান হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন। তিনি ভেবেছেন তাঁর লেখা একদিকে যেমন 'নৈতিক বিশুদ্ধতা' আনতে সহায়তা করবে, অন্যদিকে তেমনি পেরুর জনজীবনকে উন্নততর করে তুলবে; সামগ্রিকভাবে জাতীয় অগ্রগতি সাধিত হবে। নিজের লেখার এই ব্যাখ্যা দেওয়ার পর তিনি খাঁচাবিহীন পাখি শীর্ষক যে উপন্যাসটি লিখেছেন, সেই উপন্যাসটিকে ধ্রম্নপদী অর্থে বাস্তববাদী উপন্যাস বলে আখ্যায়িত করা যাবে না, কিন্তু এই উপন্যাসটি যে 'সামাজিক বাস্তববাদের' প্রতি সচেতন থেকে লেখা হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে তাঁর খাঁচাবিহীন পাখি নামের উপন্যাসটিই ছিল 'দেশজবাদে'র (ইনডিজেনিজম) ধারায় লেখা লাতিন আমেরিকার প্রথম উপন্যাস। পরবর্তী অর্ধশতাব্দী জুড়ে দেখা যাবে এই দেশজবাদী অর্থাৎ ইনডিজেনাস ধারাটিই হয়ে উঠছে লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের প্রধান ধারা। পেরুর সীমানা পেরিয়ে তাই যখন এই রীতিটি ব্রাজিলে অনুসৃত হতে শুরু করল, তখন তাতে যুক্ত হলো আরেক মাত্রা, বাস্তববাদের সঙ্গে এসে মিশে গেল লাতিন আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের জীবনগাথা। এরপর লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিকরা বিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছর ধরে এরই চর্চা করে গেছেন।

দেশজ মানুষের নির্জলা জীবনকথা বর্ণনা করার ফলে এসব উপন্যাস অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মাতোর উপন্যাসটি 'নীতিশিক্ষা'র দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে এটি পুরোপুরি প্রধান সাহিত্যের মর্যাদা পায়নি, তবে এটি যে শক্তিশালী একটি সৃষ্টিশীল রচনা হয়ে উঠেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই উপন্যাসেও আমরা 'সভ্যতা' ও 'বর্বরতা'র অনুবর্তন দেখি। সেই সঙ্গে প্রগতি ও আধুনিকতার প্রতিও ঔপন্যাসিকের ঝোঁক সুস্পষ্ট। তবে গ্রামজীবন নয়, ঔপন্যাসিক মাতো বর্বরতা আবিষ্কার করেছিলেন সরকারি প্রশাসনিক নিষ্ঠুর-বর্বর আচরণের মধ্যে। ইন্ডিয়ানদের প্রতি প্রশাসন, চার্চ ও ভূস্বামীদের বর্বর শোষণই এই উপন্যাসের প্রধান কাহিনী। কাহিনীটা সংক্ষেপে এরকম। শ্বেতাঙ্গ নারী লুসিয়া মার্টিন স্বামীর কাজের সূত্রে কিলাক অঞ্চলের আঁদিয়াঁ গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। যুপানকি ইন্ডিয়ান নামের স্থানীয় একটি পরিবারের করুণ অবস্থা দেখে তিনি তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন, কিন্তু তার এই সাহায্যকে কেন্দ্র করে ইন্ডিয়ানাদর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ বেধে যায়। মারা যায় বাড়ির অভিভাবক, আক্রান্ত হয় মার্টিনের বাড়ি। যুপানকির দুই কন্যাকে লুসিয়া পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেন, তাদের তিনি ওই গ্রাম থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন শহরে; অর্থাৎ বর্বরতা থেকে তাদের তিনি নিয়ে আসেন সভ্যতার কেন্দ্রে শহুরে সাংস্কৃতিক পটভূমিতে।

এখানেই উপন্যাসটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য বেশ প্রধান হয়ে ওঠে, আর তা হলো এর জেন্ডার পটভূমিটি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, মাতো তাঁর উপন্যাসে লুসিয়াসহ অন্য নারীচরিত্রকে তাঁর উপন্যাসে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন, তাদের সক্রিয়তাও লক্ষণীয়। মনে হতে পারে এরপর হয়তো সভ্যতার সংস্পর্শে যুপানকির ওই দুই তরুণীর জীবনে প্রগতির ছোঁয়া লাগবে। কিন্তু না, উপন্যাসটির পরিণাম ইতিবাচক নয়, এখানেই এর নামের, অর্থাৎ খাঁচাবিহীন পাখির যথার্থতা প্রতিপন্ন হয়। ওই দুই বোনের বড়টি মার্গারিতা বিয়ে করতে চায় আধুনিক এক তরুণ আইনজীবী ম্যানুয়েলকে, ম্যানুয়েলও আরেকজনের পালক পুত্র। উপন্যাসটি এখানে পৌঁছেই তীব্র এক বাঁক নেয়। ঘটনাচক্রে দেখা যায় ম্যানুয়েল এবং এই দুই পালিতকন্যার সবাই কিলাক এলাকার দুর্নীতিপরায়ণ এক আর্চবিশপের সমাজনিষিদ্ধ 'অবৈধ' সন্তান। এবার উপন্যাসে অযাচারপ্রথা মানবীয় সুখের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, রোমান্টিকতা যায় উবে, তাদের অভিশপ্ত জীবনই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। চার্চের দুর্নীতি, নারীর প্রতি বর্বর আচরণ, বিশেষ করে সভ্যতা-নৈতিকতার অভাব মানবজীবনকে কতটা দুর্বিষহ করে তুলতে পারে, এই উপন্যাসটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। লাতিন আমেরিকার নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রগতির পথে এসবই ছিল মূল বাধা, প্রধান সংকট, খাঁচাবিহীন পাখির বিষয়বস্তু সেটাই।

মাতোর উপন্যাসের পরিণাম অবশ্য অনেকটাই মেলোড্রামাটিক, চমকে ঠাসা; এ ধরনের উপন্যাস রচনায় তাঁর সমকালের অন্য দুই ঔপন্যাসিক বেস্নস্ত গানা এবং ইউজিনো ক্যামবেসেরেকে ততটা উৎসাহী মনে হয়নি। তবে এই সময়ই আবির্ভাব ঘটে সমকালীন লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ব্রাজিলের জোয়াকিম মারিয়া মাচাদো দো আসিসের (১৮৩৯-১৯০৮)। তাঁর উপন্যাস শুধু বাস্তববাদের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা নয়, হয়ে উঠেছে তার চেয়েও অনেক বড় কিছু। একক অনন্য লেখক হিসেবে তাঁর অবস্থানকে খুব সহজেই ফরাসি ঔপন্যাসিক ফ্লোবেয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যায়, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ইতিহাসে মাচাদোর গুরুত্ব অপরিসীম। যে-কারণে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে থাকেন তা হলো তাঁর সৃষ্টিশীলতার পটভূমিতেই বিশশতকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে দুনিয়াজুড়ে পাঠক সমাজে আলোড়ন তুলতে পেরেছে। তিনিই হচ্ছেন লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রধান মহান স্থপতি। মাচাদোর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি দম কাসমুরো (১৮৯৯) শীর্ষক উপন্যাসটি। প্রাথমিকভাবে একে নারীর পরকীয়া প্রেমের আখ্যান বলে মনে হতে পারে। এ ধরনের প্রেমের উপন্যাস উনিশ শতকের ইউরোপে আকসার লেখা হয়েছে, লোকপ্রিয়তাও পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাম করা যেতে পারে ফ্লোবেয়ারের মাদাম বোভারি (১৮৫৬) এবং পর্তুগীজ ঔপন্যাসিক এসা দো কোয়েরিজের (১৮৪৫-১৯০০) ও প্রিমো ব্যাসিলিও (১৮৭৮) উপন্যাসের কথা।

বেন্তো সান্তিয়াগো দম কাসমুরো মাচাদোর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, তার নামেই উপন্যাসের নামকরণ করেছেন ঔপন্যাসিক। উত্তম পুরুষের জবানিত বেন্তো তাঁর শৈশবের সঙ্গী ক্যাপিতুরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের বর্ণনা দিয়ে গেছেন এই উপন্যাসে। এই রীতিটিও উনিশ শতকের অনেক উপন্যাসে অনুসৃত হয়েছে, কিন্তু এতটা সরলভাবে মাচাদো তাঁর উপন্যাসের কাহিনী গড়ে তোলেননি। বেন্তোর বর্ণনাই মূলত এই উপন্যাসের প্রাণ, শৈল্পিক সমস্ত কারুকর্ম মূলত লুকিয়ে আছে এই বর্ণনারীতির মধ্যেই। এর কাহিনীটি অনুসরণ করলে দেখা যায়, বেন্তোকে বিয়ে করার পরই ক্যাপিতু তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, সম্পর্ক গড়ে তোলে বেন্তোরই সবচেয়ে প্রিয়বন্ধু এসকোবারের সঙ্গে।

উপন্যাসের প্রকৃত মোচড়টা এখান থেকেই শুরু হয় এরপর, এর ন্যারেটিভ ক্ষণে ক্ষণে রং-রূপ-রস বদলাতে বদলাতে এগুতে থাকে। পাঠক ঠিক ঠাহর করতে পারেন না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল বেন্তো-ক্যাপিতু-এসকোবারের জীবনে। সতর্ক পাঠকের অবশ্য দৃষ্টি এগিয়ে যায় না যে ক্যাপিতু সম্পর্কে বেন্তোর বর্ণনা যথার্থ নয়, সে ঘটে-যাওয়া কাহিনীকে নানাভাবে বিকৃত করেছে। কিন্তু কাহিনীর কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে, তাও খুব স্পষ্ট করেননি মাচাদো। ফলে পাঠককে একবার পাঠ করা অংশ আবার পাঠ করতে বাধ্য করেন মাচাদো, অনিশ্চয়তার এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়ে এভাবেই অগ্রসর হতে থাকে দন কাসমুরোর কাহিনী। বেন্তোর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর কাহিনীকে মনে হবে একরকম, আবার ঘটে যাওয়া কাহিনী অনুসরণ করলে বেন্তোর ভাষ্যের মধ্যে যে ফাঁকফোকর রয়েছে তা ধরা পড়ে যায়। একবার যেমন বেন্তো বলে তার ছেলে এজিকেল তার সন্তান নয়, কেননা এজিকেলের চেহারার সঙ্গে এসকোবারের মিল অনেক। কিন্তু তাঁর বলা কাহিনী অনুসরণ করলেই দেখা যায় এসকোবার এজিকেলের সঙ্গেই তার মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছে। এজিকেল যদি প্রকৃতই এসকোবারের ঔরসজাত হতো তাহলে সে তার সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে চাইত না। আসলে এই উপন্যাসটি বেন্তোর অপরিপক্ব ভাবনা, অস্থিরচিত্ততা, উদ্ভট কল্পনা আর দোলাচল মানসিক বৈকল্যের নানা বর্ণনায় ভরা। উপন্যাসের শেষে বেন্তো সরাসরি পাঠকদের লক্ষ করে বলে : 'আপনারা আমার লগে একমত হইবেন, যদি ক্যাপিতু নামের মাইয়াঁরে মনে রাখেন তাইলে নিশ্চয়ই প্রয়োজন মতো ভাইবা নিতে পারবেন, একের মইদ্যেই আছে আরেকজন, যেমন থাকে খোলসের পিছে ফলের শাঁসটা।' এই কথাগুলো নিঃসন্দেহে ইতিপূর্বে তারই বর্ণিত কাহিনীকে একেবারে অনিশ্চিত, অস্থিতিশীল করে দেয়। সমালোচকদের মতে এটাই হচ্ছে আধুনিক আখ্যানের, ন্যারেটিভের, কাহিনী বর্ণনার প্রধান রীতি ও বৈশিষ্ট্য। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীকে বহুবর্ণিল আর বহুকৌণিক করে তোলাই হচ্ছে আধুনিক কথাসাহিত্যের, আখ্যান বা ন্যারেটিভের মূল কথা। বাস্তবতা যে প্রকৃতপক্ষে কী, কোথায় সত্যের শিকড়, সেই বাস্তবতা কী প্রকৃতই বাস্তবতা, না কি বাস্তবতারও আছে নানা মাত্রা, নানা ব্যাখ্যা, নানা সূত্র- পাঠককে গোলকধাঁধায় ফেলে মোহাচ্ছন্নের মতো কাহিনীর গভীর থেকে গভীরে নিয়ে যাওয়াই হচ্ছে আধুনিক ঔপন্যাসিকের প্রধান কাজ। নানা দৃষ্টিকোণ আর জট তৈরি করে করে ঔপন্যাসিক দেখাবেন অনেক কিছু, জটগুলো খুলতেও থাকবেন একটু একটু করে আর পাঠক তার ভেতর থেকে নিজের মতো করে ঝিকিয়ে ওঠা সত্যকে ছুঁয়ে দেবেন এভাবেই। বিশ শতকের আধুনিক উপন্যাসের নন্দনতত্ত্ব হচ্ছে এটাই। মাচাদো এই আখ্যানরীতিরই প্রথম মহান স্থপতি, লাতিন আমেরিকার সনাতন বাস্তবতার সীমাকে তিনি এভাবেই অতিক্রম করে বিশ শতকের আধুনিক উপন্যাসের বর্ণনারীতি বা ন্যারেটিভের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। তিনিই হয়ে উঠেছেন বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভূত লাতিন আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক হুলিয়ো কর্তাজার (১৯১৪-৮৪), কার্লোস ফুয়েন্তেস (জন্ম ১৯২৮), গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও মারিয়ো ভার্গাস ইয়োসার (জন্ম ১৯৩৬) গুরু, 'নতুন আখ্যানে'র পথিকৃৎ; বোর্হেসের ঋণও এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য।

মাচাদোর উপন্যাসের যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হলো তার অর্থ এই নয় যে এটি শুধু বর্ণনার বিশিষ্ট ভঙ্গির জন্য লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের ইতিহাসে উলেস্নখযোগ্য হয়ে আছে। উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে সুনির্দিষ্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিতেই নির্মিত, যে-পটভূমি আসলে লাতিন আমেরিকারই। উপন্যাসটির ঘটনা এমন একটা সময় (১৮৪০-৮৯) ঘটেছে যখন ব্রাজিলে চলছিল সাম্রাজ্য শাসনের দ্বিতীয় পর্ব। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের মাধ্যমে তখন থেকেই ব্রাজিল মূলত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যায়। তবে ব্রাজিলের অর্থনীতি তখনো দাসশ্রম আর চিনি ও কফি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৮৮৮ সালে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে, সেই সঙ্গে অবসান ঘটে সাম্রাজ্যের ও সূত্রপাত ঘটে ভবিষ্যৎ প্রজাতন্ত্রের (১৮৮৯)। মাচাদোর উপন্যাসটির ঘটনাস্থান যদিও রিও ডি জেনিরো, তবে বেন্তোর সম্পদের উৎস হচ্ছে গ্রাম, যেখানে দাসপ্রথা প্রচলিত রয়েছে আর চাষাবাদই হচ্ছে এই অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। ধীরে ধীরে ওই সময় থেকেই ব্রাজিলের সামন্তবাদী অর্থনীতি বাণিজ্য অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। অন্যদিকে বেন্তো ক্যাপিতু, অর্থাৎ নারী সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে, তাকে ব্রাজিলের সমকালীন পুরুষতন্ত্রের রূপক হিসেবে উলেস্নখ করা যায়। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের মতো পুরুষতন্ত্রের প্রভাবও তখন ক্রমশ ক্ষীয়মাণ হয়ে আসছিল, ব্রাজিলীয় সমাজের সর্বত্র লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। মাচাদোর দম কাসমুরা শীর্ষক উপন্যাসকে এসব দিক থেকে ব্রাজিলের উনিশ শতকের শেষ দিককার সাংস্কৃতিক বয়ান হিসেবে উলেস্নখ করা যায়, যে-সংস্কৃতিতে রাজনীতি ও অর্থনীতি দুই-ই দ্রম্নত রূপান্তরিত হচ্ছিল। তবে বিস্ময়কর হচ্ছে, এই সেদিন, অর্থাৎ বিশ শতকের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে উপন্যাসটির মহিমা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের সমালোচকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। তারা একটা মহৎ উপন্যাস হিসেবে আবিষ্কার করে এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, এর আগে এই উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে নিজের মতো করে এর দুটি ভাষ্য রচনা করেন আমেরিকার হেলেন ক্যাল্ডওয়েল এবং ইংল্যান্ডের জন গেস্নডসন যথাক্রমে মাচাদোর ব্রাজিলীয় ওথেলো (১৯৬০) ও মাচাদোর গোলকধাঁধাময় বাস্তবতা (১৯৮৪) শিরোনামে। এই দুটি রচনাকে আসলে 'উপন্যাস থেকে উপন্যাস' রচনার দৃষ্টান্ত হিসেবে উলেস্নখ করা যায়, অর্থাৎ ক্যাল্ডওয়েল ও গেস্নডসন দু'জনেই মাচাদোর মূল উপন্যাসকে অবলম্বন করে আধুনিক রীতিপ্রকরণ ও ভাষায় একই কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে আরও দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই বোঝা যায়, মাচাদোর দম কাসমুরা উপন্যাসটির মহিমা কতদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে, পরবর্তীকালে এতটা সমাদৃত হওয়া সত্ত্বেও সমকালে কেন উপন্যাসটির ওপর সমালোচকদের দৃষ্টি পড়েনি, কেন এটি উপেক্ষিত থেকে গেছে। এর উত্তরে বলা যায়, ১৯৬০ দশকের পূর্বপর্যন্ত অর্থাৎ লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ইতিহাসে যখন বিখ্যাত 'বুম' লেখকদের রচনারীতির শেকড় খোঁজা শুরু হয়, তখনই তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসে মাচাদোর দম কাসমুরা উপন্যাসটি। সমালোচকরা আরও লক্ষ করেন, উনিশ শতকের শেষদিক থেকে শুরু করে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাস্তববাদই ছিল লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এরই ধারাবাহিকতায় বিশ শতকের প্রায় শুরুতে লাতিন আমেরিকার উপন্যাস একটা বড় ধরনের বাঁক নেয়। লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যে আবির্ভাব ঘটে আধুনিকতা বা 'মর্ডানিজমো' আর 'ভনগুয়ার্দিয়া' বা আভাঁগার্দ রীতির। এর পরের ইতিহাস তো বিশ্বজয়ের ইতিহাস। হুলিয়ো কর্তাজার, কার্লোস ফুয়েন্তেস, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও মারিয়ো ভার্গাস হোসা- এই লেখক চতুষ্টয়ের মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে অবিস্মরণীয় কীর্তি হিসেবে পাঠকের মনে স্থান করে নেয়। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাস্তববাদের প্রতিক্রিয়াতেই লাতিন আমেরিকায় ওই আধুনিক সাহিত্যের সূত্রপাত ঘটে। পরে এ সম্পর্কে আমি যখন বিশদভাবে আলোচনা করব, তখনই পাঠক দেখতে পাবেন, কীভাবে একটা বিশেষ প্রজন্মের হাতে মহান এক উপন্যাসধারার সূত্রপাত ঘটছে। ফলে, বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকে দেখা গেল, আঠার শতকের শেষদিকে যেমন, ঠিক তেমনি তখনো বাস্তববাদী ধারাতেই জাতীয় আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করে চলেছেন লাতিন আমেরিকার সমকালীন ঔপন্যাসিকরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে