সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাটক আবির্ভাবের একাল-সেকাল

জি বি এম রুবেল আহম্মেদ
  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

যুগ যুগ ধরে বহু দেশ নাটকের মাধ্যমে জাগ্রত হয়েছে। নাটক হচ্ছে সাহিত্যের অন্যতম একটি অংশ। যখন মানুষ কথা বলা শিখেনি বা সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি, তখন ইশারায় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই মনের ভাব প্রকাশ করত। আদিযুগ বা গুহার সময়ে সভ্যতা, শৃঙ্খলা ও সামাজিকতা তাদের মধ্যে কিছুই ছিল না। তখনকার মানুষ গাছের পাতা, ফল ও পরবর্তীতে বাইসন অর্থাৎ হরিণ শিকার করে আহার করত। একে অপরকে বাইসন শিকার করার দৃশ্যপট শেখানো হতো। সেটা কোনো ধ্বনির মাধ্যমে নয়। এটা ছিল মুখাভিনয়ের মাধ্যমে। আর সেই বাইসন শিকার থেকেই পৃথিবীতে অভিনয়ের উৎপত্তি ঘটে। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে নাটকের সৃষ্টি। নাটকের প্রথম উৎপত্তি ঘটে গ্রিসে। ১৮৫২ সালে রচিত তারাচরণ শিকদারের 'ভদ্রার্জুন'কেই বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক নাটক হিসেবে ধরা হয়। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন জারি করেন লর্ড নর্থ্রবুক। ভারতীয় নাটকের আদি উৎস ছিল ভরতমুনির লেখা নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থ। মৃচ্ছকটিক নাটকের লেখক শূদ্রক।

বাংলা আধুনিক নাটকের সূচনা ঘটেছিল 'বেলগাছিয়া নাট্যশালা' থেকে। রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ এবং তার ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এই নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই নাট্যশালায় ইউরোপীয় নাট্যমঞ্চের আদলে সামনে খোলা ও তিন দিক বদ্ধ করে মঞ্চ তৈরি করা হয়। আর আমাদের দেশে যে মঞ্চ ছিল তা মূলত চারদিক খোলা এবং অভিনয় শিল্পীকে তার চারদিকের দর্শকের কথা ভেবে খুব দক্ষতার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করতে হতো। যার নাম ছিল 'যাত্রাপালা'। এ থেকেই আমাদের আধুনিক নাটকের শিকড়ের জন্ম হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের পরে অনেকেই নাটক রচনায় চেষ্টা করেছেন কিন্তু কেউই বিশেষ কোনো ধারার প্রবর্তন করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে তার কাব্যপ্রতিভাকে নাটকে বিশেষভাবে প্রকাশ করেন। গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, কাব্যনাট্য প্রভৃতি নাটক রচনার মাধ্যমে বাংলা নাট্য সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত পারিবারিকভাবেই নাটকের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তৎকালীন সমাজের ব্রিটিশ শোষণ ও সমাজের বাবু সম্প্রদায়ের অনৈতিক কাজের চিত্রই তুলে এনেছেন নাটক ও প্রহসনের মাধ্যমে। বিশেষ করে জমিদার বাবুদের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও রক্ষিতা রাখা, মদ পান করার যে প্রথা প্রচলন ছিল তাই দীনবন্ধু মিত্র 'সধবার একাদশী'র মাধ্যমে ব্যঙ্গরসাত্মক বর্ণনার মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। সে সময় আরও নাটক লিখতেন- কালিদাস, দেবীচন্দ্রগুপ্তম। ঊনিশ ও বিশ শতকের বাংলা নাট্যকার ছিলেন- মধুসূদন দত্ত, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শিশির বাদুড়ী, কাজী নজরুল ইসলাম ও শম্ভু মিত্র। জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করে এমন কয়েকটি নাটকের মধ্যে অন্যতম- সুরেন্দ্র বিনোদিনী, গজদানন্দ ও যুবরাজ, সরোজিনী, অশ্রম্নতি ও নীলদর্পন। পরে বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস লেখেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

এরপর দীর্ঘ দেড় শত বছরে বাংলা নাটক নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পূর্বে বাংলা নাটক ও নাট্যচর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ফলে আমাদের এ অঞ্চলে নাটক তেমন বিকশিত হয়নি। দেশবিভাগের পর থেকেই পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ নাটক রচনায় একটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর নাটক রচনা ও নাট্যচর্চায় ব্যাপক রূপান্তর ঘটে। এ সময় থিয়েটার আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাটকে লাগে পালা বদলের হাওয়া। রচিত হয় বহু নতুন আঙ্গিক নাটক। ১৯৪৭ থেকে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধে কালপর্বে যারা নাটক লিখেছেন তারা হলেন- নুরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্‌, সিকান্দার আবু জাফর, সাঈদ আহমদ, আসকার ইবনে শাইখ ও জিয়া হায়দার।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যকে প্রধানত পাঁচটি শাখায় বিন্যস্ত করা হয়।

ক. মুক্তিযুদ্ধের নাটক

খ. প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের নাটক

গ. ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরাণ পুনর্মূল্যায়নধর্মী নাটক

ঘ. অনুবাদ ও রূপান্তরিত নাটক

ঙ. সামাজিক নাটক।

পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যেসব নাট্যকার নাটক লিখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম জায়গা দখল করে আছেন : মমতাজউদ্দীন আহমদ- 'স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা', নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন- 'করিম বাওয়ালীর শক্র বা মূল মুখ দেখা' ও 'কীর্তনখোলা'। এ ছাড়াও লিখেছেন রাজীব হুমায়ুন- 'নীল পানিয়া, আবদুল মতিন- 'মাননীয় মন্ত্রীর একান্ত সচিব', এস এম সোলায়মান- 'ইঙ্গিত' ও 'এই দেশে এই বেশে'। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরাণের অনুষঙ্গে নাটক রচনায় এক নতুন মাত্রা সঞ্চারিত হয়। আর এ ধারায় উলেস্নখযোগ্য নাটক এবং নাট্যকাররা হলেন- সৈয়দ শামসুল হক-'নূরলদীনের সারাজীবন', সাঈদ আহমদ- 'শেষ নবাব', মমতাজউদ্দীন আহমদ- 'স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা', ড. সেলিম আল দীন- 'অনিকেত অন্বেষণ', 'শকুন্তলা', আবদুল মতিন খান- 'গিলগামেশ'। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের অন্যতম প্রবণতা বিদেশি নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তকরণ। এ সময়ে যেসব নাট্যকারের নাটক রূপান্তরিত হয়েছে। তারা হলেন- শেক্সপিয়র, মলিয়ের, মোলনার, বেকেট, ইয়োসেনেস্কো, ব্রেখট, সার্ত, কামু্য, এ্যালবি প্রমুখ।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সমাজের চিত্রকে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরে মুনীর চৌধুরী রচনা করেন 'কবর' নাটক। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের মতো করে এতো বৈচিত্র্য আঙ্গিকে কেউ নাটক রচনা করতে না পারলেও ড. সেলিম আল দীন উনিশ শতক পেরিয়ে বিশ শতকে এসে নাটকের আঙ্গিকে বিশেষ বিশেষ কিছু দিক আনতে সক্ষম হয়েছেন, যা তার পূর্বে কেউ পারেনি। নাটক যে শুধু সংলাপ নির্ভর নয়- তা বাংলা নাট্য সাহিত্যে সেলিম আল দীনের পূর্বে কেউ করে দেখাতে পারেননি। এর স্পষ্ট প্রমাণ দেখা যায় তার রচিত- 'চাকা' নাটকে। তবে সেলিম আল দীনের পরে বাংলা নাটকের বিশেষ কোনো পরিবর্তন বা নতুন ধারার সূচনা এখনো হয়নি। তবে নাট্য আন্দোলন ও থিয়েটার ভাবনা সর্বত্র পৌঁছে দিতে ড. সেলিম আল দীন ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুসহ আরও অনেক প্রবীণ-নবীন নাট্যকারদের নিয়ে 'বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার' প্রতিষ্ঠিত করেন। দেশের প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের বার্তা পৌঁছে যায়। থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে সারথি হোন দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ের নাট্যকার, নাট্যকর্মীরা।

কালের পরিক্রমায় ডিজিটাল যুগে এখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নাটক মঞ্চায়িত হয়, প্রদর্শিত হয় পথনাটক। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েক শতাধিক থিয়েটার। সংস্কৃতি চর্চাকে বেগবান করতেই থিয়েটার কর্মীরা এখনো নাটকের মাধ্যমে সমাজের অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার, জুলুম-অত্যাচার ও অপশক্তি রুখতে নাটক প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। সমাজের হাতিয়ার হিসেবে নাটককেই বেছে নিয়েছেন নাট্যকর্মীরা।

জয় হোক বাংলা নাটকের

জয় হোক থিয়েটার চর্চার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে