শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

মনপোড়া কষ্ট

অমল বড়ুয়া
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মনপোড়া কষ্ট

'বাবারা কেমন হয়!'

বাবারা কী সাদা কালো কিংবা রঙিন ছবি হয়ে চকচকে বার্নিস করা কাঠের ফ্রেমে শুধু বন্দি হয়ে রয়! অতপর দেয়ালে ঝুলে থেকে স্মিথহাস্যে সন্তানকে অভয় দেয়, 'হে বৎস, চিন্তা করিও না। আমি আছি সঙ্গে তোমার সর্বক্ষণ, সর্বকাজে।' ঘরের দরজার চৌকাঠের ওপর টাঙ্গানো দশ-বারো সাইজের সাদা-কালো ছোপ ছোপ দাগ আর বড় বড় ক্ষতে বিধ্বস্ত ছবির দিকে অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে ভাবছে বসু। বাবা কেমন হয় তার খুব জানতে ইচ্ছে করে। সেদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কথা। মা মুখটা বেজার করে কিছুক্ষণ বসুর দিকে স্থির দৃষ্টিপাত করে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। মায়ের মুখটা হঠাৎ বিবর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অক্ষিকোটরের পাতা দু'টি সযতনে বিছিয়ে নিয়ে কী যেন আড়াল করল। মা আর তার চোখের দিকে তাকাল না। শুধু বলল, 'যা খোকা। পড়তে বস।'

খেলার মাঠে সেদিন সুধীর তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। সাদা থানকাপড়ে নিজেকে মুড়িয়ে রাখা সেই বুড়ি মা তাকে টেনে তুলেছিল। সুধীরকে ধমক দিয়ে বলেছিল, 'ওই, তুই ফের যদি এর ওপর হাত তুলিস তোর খবর আছে কিন্তু। এতিম একটা পোলার গায়ে হাত তুলতে তোর লজ্জা করে না?' পাড়ার কোনো কোনো ছেলে তাকে খেলতে নেয়। আবার কেউ কেউ এড়িয়ে যায়। মাদল খেলার মাঠে প্রতিদিন ললিপপ চুষতে চুষতে আসে। জিজ্ঞেস করলে বলে, 'বাবা কিনে দিয়েছে।'

মাদলের মতো তারও খুব লজেন্স খেতে মন চায়। ললিপপ খুব মজার। মুখে পুরলে আহা কী দারুণ স্বাদ! মনটা জুড়িয়ে যায়। মুখভর্তি রস আর রস। মিষ্টি মিষ্টি রস। তপু তাকে ধাক্কা দেয়, 'অই বসু, চোখ বন্ধ করে কী ভাবছিস?' হুট করে মুখ থেকে ভাবনার ললিপপটা মাটিতে পড়ে যায়। মনটা কেমন বিষাদে ভরে যায়। ভাবনার সিঁড়ি থেকে নেমে তপুর কাঁধে হাত দিয়ে বলে, 'চল, খেলতে যাই।' মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে করে জানতে বাবারা কেমন করে সন্তানকে বুকে নিয়ে ঘুমায়। তপুকে প্রায় সময় দেখে বাবার বুকে মুখ গুজে শোয়ে থাকতে। তার মাথায় সস্নেহে বিলি কাটতে। সেদিন আশীষ আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। তার বাবা দোলন কাকা এসে মাটি থেকে তাকে তোলে নিল। হাত-পা প্যান্ট জামা খুব ভালো করে ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার করে দিল। তারপর আদর করে কোলে তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। বাবার আদর পেয়ে আশীষ বেমালুম ব্যথা ভুলে হাসছিল। বসু ভাবে, 'তাহলে বাবার আদর মহৌষধের মতো। কান্না ভুলিয়ে দিয়ে হাসি আনতে পারে।'

তার বুকটা ধড়পড় করে ওঠে। কেন করে ওঠে বুঝতে পারে। তার তো কোনো অভাব নেই। শুধু ঐ একটা ছাড়া। আর তা হলো তার একটা বাবার অভাব। বসু মায়ের চারপাশে ঘুরে। বারবার বলতে চায়। বলতে গিয়ে আবার নিজে নিজে গুটিয়ে যায়। বাবার কথা বললে যে মা'টা কেমন যেন আনমনা হয়ে যান। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকান। কখনো নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সরে পড়েন। মায়ের গোমরা মুখটা দেখলে বসুর বুকটা কেমন করে ওঠে। তার তখন কিছুই ভালো লাগে না। তখন সে নিজেকে নিজে প্রবোধ দেয়, 'মা তো আছে। প্রতিদিন আদর করে। খাওয়ায়। স্নান করায়। মাথার চুল আঁচড়ে দেয়। মাঠ থেকে ফিরলে ঘাম মুছে দেয়। পড়তে বসায়। আর মন খারাপ হলে গল্প শোনায়। জানো, মা কতো গল্প জানে। তাই মাকে আমি গল্প বুড়ি বলি। মা তখন খিল খিল করে হাসে। মা যখন হাসে তখন আমার কি যে ভালো লাগে!'

উৎপলদের বাড়িতে বেড়াতে গেছে বসু তার মায়ের সঙ্গে। উৎপলদের ঘরের মাটির দেয়ালে কাঁচের দরজা দেওয়া একটা লম্বা চওড়া খোপ আছে। উৎপলের মা বলেছেন, 'এটা আমাদের শো-কেস।' ঐ শো-কেসটা বসুর খুব পছন্দ হয়েছে। বসু সুযোগ পেলেই ঐ শো-কেসের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। শো-কেসটা ছোট্ট হলেও অনেক জিনিষ রাখা আছে। ছোট পুতুল। তার চোখগুলো কেমন করে যেন নড়া-চড়া করে। চেহারাটাও কী মিষ্টি! আর আছে সুন্দর পাখাওয়ালা একটি হেলিকপ্টার। ওর পেট ফেড়ে চারটা ইয়ে বড় ব্যাটারি লাগিয়ে চাবি দিলে ওটা ফড়ফড় করে উড়তে থাকে। উড়ে উড়ে ওপরে ওঠে যায়। আবার নেমে আসে। উৎপল বলল, 'জানো, বাবা আমার জন্য কতো কতো পুতুল, খেলনা আর লজেন্স নিয়ে আসে!' বসুর বুকটা টিপটিপ করে। চোখ দু'খানা ভারী ও ঝাপসা হয়ে ওঠে। দম আটকে যেতে চায়। সে আর দাঁড়িয়ে উৎপলের কথা শুনতে পারে না। তার শুধু কান্না পাচ্ছে। সে ভাবছে, 'আহা! আমি কতো অভাগা। আমার যদি এমন একটা বাবা থাকত তাহলে কতো কতো খেলনা আমারও থাকত।'

ভোরে উৎপল একটা লম্বা চকচকে কাঠির মতো আগায় সাদা সাদা নরম আঁশযুক্ত কিছু একটা দিয়ে দাঁত দু'পাটি চেপে ধরে ঘষে যাচ্ছে তো ঘষে যাচ্ছে। আর তার মুখ থেকে কাঁশফুলের মতো ধবধবে সাদা ফেনা বের হচ্ছে। বসু ঘুমকাতর চোখ দুটোকে চুলকাতে চুলকাতে উৎপলের সামনে দাঁড়িয়ে হাই তোলে জিজ্ঞেস করছে, 'তুমি এটা দিয়ে দাঁতে ঘোষছ কেন?' উৎপল মুখ থেকে ধবধবে সাদা ফেনাগুলো থু বলে ফেলে একগাল হেসে বলে, 'এটা ব্রাশ। আমি টুথপেস্ট ও ব্রাশ ব্যবহার করে দাঁত মাজি। একটা শেষ হবার আগে আমার বাবা আরেকটা এনে দেয়।' বসু একটু অবাক হয় বটে। সে তো রোজ সকালে কয়লা বা ছাই দিয়ে দাঁত মাজে।

বসু রান্নাঘরে মায়ের আঁচল ধরে থাকে। মুখ ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে। মা চোখে চোখে তাকায়। বুঝতে পারে বসু ফুসে উঠছে অবিরাম। তাই আদর করে মন ভোলাতে চায়। বসু তাতে সায় দেয় না। মা শুধায়, 'কী হয়েছে বাপ আমার?' বসু ত্যক্তবিরক্ত হয়ে বলে, 'আমার পুতুল লাগবে।' মা হাসে আর বলে, 'তুই কি মেয়ে রে খোকা? পুতুল খেলে তো মেয়েরা।' মায়ের কথা শোনে ভরকে যায় ঠিকই কিন্তু নিরাশ হয় না। বলে, 'আমার ব্রাশ আর টুথপেস্ট লাগবে।' মা হেসে হেসে বলে, 'আমরা গরিব। এত দামী জিনিষ আমরা ব্যবহার করি না। যখন তোর টাকা হবে তখন তোর জন্যও কিনবি আর আমার জন্যও।' গজগজ করে বসু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। সে বুঝতে পারে এখন যদি বাবার কথা বলে তবে মায়ের মনটাও খারাপ হবে।

সেদিন বসুদের বাড়িতে এক লোক এসে হাঁক ডাকছে, 'ও বসুর মা, তুমি কই গেলা?' বসু লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, 'তুমি কে গো? আর আমার মাকে কেন ডাকছ?' বসুর প্রশ্ন শোনে লোকটা বলল, 'আমাকে চেন না! অ চিনবা কেমন করে। তোমার জন্মের আগেই তো আমি বিদেশ চলে গেলাম। এখন আসলাম। আমি তোমার বাবা।' বাবা কথটা শোনেই বসুর মনটা এক দারুণ শীতলতায় হিম হয়ে গেল। অনিন্দ্য পুলক আর ভালো লাগায় হৃদয়টা কেঁপে কেঁপে উঠল। মনের চঞ্চলতা বেড়ে গেল। কিন্তু তথাপি তার মনে চিন্তার উদয় হলো 'মা তো আমাকে কখনো বলেনি আমার বাবা আছে!' পেছন থেকে তার মা এসে হেসে বলছেন, 'কি রে তুমি কখন আসলে? বস।' বসু এবার মাকে প্রশ্ন করল, 'মা, উনি কে?' মায়ের উত্তর পাওয়ার আগেই লোকটা হেসে হেসে বলল, 'আরে খোকা, তোমাকে বলছি না আমি তোমার বাবা। তোমার বিশ্বাস না হলে মাকে জিজ্ঞেস কর।' এরপর লোকটাকে দেখলে বসু বাবা বলে ডাকত। তার ভালো লাগত। পাড়ার সবাই মুখ টিপে হাসত। বসু যখন বড় হলো তখন বুঝতে পারল আসলে তিনি তার বাবা ছিলেন না। পাড়ার কাকা।

এখন বসু অনেক বড় হয়েছে। পিতৃহীন জীবনের একুশ ভাদ্র পার করে এসেছে মনপোড়া নিঃসঙ্গতায়। সে জানতে পেরেছে তার জন্মের নয় মাসের মাথায় বাবা অসুখে মারা গেছে। বাবার কোনো স্মৃতিই তার মস্তিষ্কে আলোড়ন তোলে না। বাবার স্পর্শের কোনো অনুভূতি তার শরীরে কিংবা মনে দাগ কাটে না। বাবা কেমন হয় তাও সে জানে না। বাবার চেহারা কেমন সে তাও জানে না। বয়োবৃদ্ধ কেউ একজন বলেছিল, 'তুই মোহনের ছেলে না! তোর নাক, চোখ, চেহারা সব মোহনের মতো হয়েছে।' বসু মাঝে মাঝে নিজের চেহারায় হাত বুলায় যদি তাতে বাবাকে অনুভব করা যায়! মাঝে মাঝে নাক ছুঁয়ে দেখে যদি বাবার নিঃশ্বাস তাকে স্পর্শ করে যায়! ঢ্যাব ঢ্যাবে দু'চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকায় যদি বাবার চোখে চোখ পড়ে। এই বিশাল পৃথিবীতে সে নিঃসঙ্গ একাকি পথ হাঁটে যদি কখনো অশরীরি বাবা এসে তার হাত ধরে পথ দেখায়! সে চোখ বন্ধ করে বাবাকে অনুভব করতে চায়। স্বপ্ন দেখতে চায় বাবা তার কাঁধে হাত রেখে বলছে, 'তুই একা নস খোকা আমিও আছি তোর সঙ্গে...'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে