শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিপটে মুজিবনগর

আল-আমিন
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
স্মৃতিপটে মুজিবনগর

গোধূলি লগ্নে আনমনা হয়ে বসে আছি। হঠাৎ ! মৃদু আওয়াজে ফোনটি ভাইব্রেশন হল। মুহূর্তেই আনমনা ভাব কেটে গেল। ফোনটি হাতে নিয়ে দেখলাম ক্লাসের একমাত্র লয়াল ছেলে নাহিদ কামালের ম্যাসেজ। সে বললঃ বন্ধু, পরীক্ষা তো শেষ, চলো ঘুরতে যাই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আর কেউ যাবে? ওপাশ থেকে সে মেয়েলি কণ্ঠে জানাল আরিফ জুমানও যাবে।

বইয়ে পড়ার বিষয় স্বচক্ষে দেখলে পরিপূর্ণভাবে জ্ঞান অর্জিত হয়। যাতে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা ১%এ চলে আসে। ছোটবেলা থেকে পড়ে এবং শুনে আসছি যে, ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত মুজিবনগরের কথা। তাই সুযোগ মিস করলাম না।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ঝিনাইদহ থেকে ক্যাম্পাসে আসি। ক্যাম্পাসে ঢুকে দেখলাম আন্দোলন চলছে। টানা দেড় ঘণ্টা আন্দোলনের পর বাস ছাড়ল।

তিনবন্ধু খুবই উৎফুলস্ন মনে মুজ-মাস্তির সঙ্গে যাচ্ছি। বটতৈল যাওয়ার পর ক্যাম্পাসের বাসকে বিদায় জানিয়ে চুয়াডাঙ্গার বাসে উঠলাম। পাশের ছিটে উড়ে এসে জুড়ে বসল এক ললনা। পুরোটা পথ অস্বস্তিতে কাটাতে হলো।

চূয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুর যাওয়ার সময় পথিমধ্যে আমঝুপি নীলকুঠিতে নামলাম। কুঠির প্রধান ফটকে নেমে শুরু হলো ফটোশুট। একে একে সিঙ্গেল ও গ্রম্নপ ছবি তুললাম। চারপাশে ঘুরে-ফিরে জাদুঘরের সন্নিকটে গেলাম।

জাদুঘর দেখে আনিসুজ্জামানের লেখা 'জাদুঘরে কেন যাবো ?' গদ্যটি মনে পড়ল। কিছু না ভেবে টিকিট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

জাদুঘরে রয়েছে বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে বিজড়িত বহু স্মৃতি। সেখানে দেখতে পেলাম, বাংলার ইতিহাসের প্রথম ইংরেজ শাসক, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি লর্ড ক্লাইভের ছবি। তাকে দেখে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস। যিনি মীর জাফরের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আরও দেখতে পেলাম, নীলকরদের অত্যাচারের কিছু নমুনা।

ইতোমধ্যে মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে আজানের আওয়াজ কানে ভেসে উঠল। গুটিগুটি পায়ে মসজিদের দিকে রওনা হলাম। নামাজ শেষে হোটেলে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম।

এরপর ইজিবাইকে মেহেরপুর পৌঁছলাম। মন জুড়িয়ে গেল মানচিত্র খচিত স্থান দেখে। যেখানে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেছিল, সেটার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের তিনজনের মধ্যে দুইজন ভোলার। ভোলার মানচিত্র কোথায় ঝটপট খুঁজে বের করল আরিফ জুমান। সেখানে কিছুক্ষণ ফটোশুট করার পর চলে গেলাম আম্রকাননে।

১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। সেই সময় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদসহ মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণ করেন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের এখনো বাংলাদেশ ও ভারতের বর্ডারে যাওয়া হয়নি। তড়িগড়ি করে একটা ভ্যান নিলাম। ভ্যান মামা আম্রকানের গল্প শুরু করলেন, কিন্তু শেষ করার পূর্বেই বর্ডারে পৌঁছালাম। সেখানে দুইজন গার্ড বসে ছিলেন। আমরা গিয়েই তাদের সালাম দিলাম। দ্বিতীয় জন একটু দূরে থাকায় সালাম শুনতে পায়নি। তারা বলল, তোমরা হুজুর মানুষ হয়ে সালাম দিলে না যে? তখন আমরা বললাম স্যার, সালাম দিয়েছি। আমাদের সামনে বসা উনিও বললেন ওরা সালাম দিয়েছিল। এরপর তাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বলার পর সেখান থেকে চলে আসলাম।

মাগরিবের আজান হলো মুজিবনগরের ভেতরের মসজিদে নামাজ আদায় করে মেহেরপুর শহরে চলে আসলাম।

আরিফ জুমান ও নাহিদ আবদার করল, তারা মেহেরপুরের বিখ্যাত সাবিত্রী খাবে। আমি বললাম, এখন আর সময় নেই। আমাদের ফিরতে হবে। কিন্তু নাহিদ নাছোড় বান্দা। সে না খেয়ে ফিরবেই না। তার কথা মতো মিষ্টির দোকান খুঁজতে লাগলাম। দুঃখের বিষয় ! সেদিন যে দোকানটিতে সবচেয়ে ভালো সাবিত্রী বানানো হয়, সেটি বন্ধ ছিল। অবশেষে একটি দোকান থেকে সাবিত্রী, বালিশ মিষ্টি, রসভোগ খেলাম।

এবার ফিরে আসার পালা। কাউন্টারের টিকিট মাস্টারের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সে জানাল, রাত ১০টার পর কুষ্টিয়ার কোন গাড়ি থাকে না। পড়লাম মহাবিপদে। ওদের জিজ্ঞাসা করলাম। এখন কি করবি ? আরিফ বলল, আমাদের বন্ধু নিহাজুর রহমান সেলিমের বাসা তো মেহেরপুরে। তৎক্ষণাৎ ওরে ফোন দিয়ে কুশলবিনিময় শেষে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় আছোছ? ও জানাল কুষ্টিয়াতে। নিহাজ আমাকে জিজ্ঞাসা করল তুই কোথায় আছিস? আমি মেহেরপুর আছি। এ কথা জানোনোর পর ওদের বাড়িতে যেতে বলল। ওকে না করে দিলাম। অবশেষে মারকাজ মসজিদে রাতে অবস্থান করি। তাদের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

সকালে মেহেরপুরের আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভে আমদহ গ্রামের স্থপত্যে গেলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে প্রত্যাশিত জায়গাটি পেলাম না। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, অনেক আগেই ওই স্তম্ভটি হারিয়ে গেছে। এভাবেই স্মৃতিপটে যুক্ত হলো ঐতিহাসিক মুজিবনগর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে