শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া

বাঙালির হৃদয় জয় করেছি এটাই বড় পাওয়া কিশোয়ার চৌধুরী

নন্দিনী ডেস্ক
  ২৬ জুলাই ২০২১, ০০:০০

অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো 'মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া'র গ্র্যান্ড ফিনালেতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান কিশোয়ার চৌধুরী নূপুর দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়েছেন। দেশে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাকে নিয়ে চলছে উচ্ছ্বাস। প্রতিটি বাঙালির হৃদয় জয় করে নিয়েছেন ৩৮ বছর বয়সি এই বাঙালি নারী।

সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন, কিশোয়ার চৌধুরী ও তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল চৌধুরী। কিশোয়ার বলেন, 'আমি ট্রফি জয় করতে না পারলেও বাঙালির হৃদয় জয় করেছি, এটাই আমার বড় পাওয়া।'

একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে কিশোয়ার জানান, এই মুহূর্তে তিনি মিডিয়ার সঙ্গে তার এজেন্সির অনুমতি ছাড়া সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না।

কথা হয় তার বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কামরুল চৌধুরীর সঙ্গে। মেয়ের সাফল্য তার কণ্ঠ আবেগে উদ্বেলিত। তিনি বললেন, 'এতদিন শুনেছি, বাঙালিরা প্রশংসা করতে জানে না। এতদিন দেখে এসেছি, একজন বাঙালির সাফল্যে অন্যরা ঈর্ষান্বিত হয়। কিন্তু কিশোয়ারের সাফল্যে দেখছি সারা পৃথিবীর বাঙালিরা উলস্নাস করছে, আনন্দ করছে, অহংকার করছে।'

কামরুল চৌধুরী আরও বলেন, 'আমাদের নিজেদের সাফল্যের চেয়ে যখন আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের সাফল্য দেখি, তখনই বেশি ভালো লাগে।'

কিশোয়ারের বাবা কামরুল চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ৫০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। বর্তমানে বাস করছেন মেলবোর্ন শহরে। অস্ট্রেলিয়া সরকারের সর্বোচ্চ খেতাব 'অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া মেডেল'-এ ভূষিত হয়ে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের অহংকার আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।

তিনি আপাদমস্তক একজন বাঙালি। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের সব অনুষ্ঠান, উৎসব ও সমস্যায় কামরুল চৌধুরী অপরিহার্য একটি নাম। তিনি জানান, কিশোয়ারের ছোটবেলা থেকেই রান্নার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। তার বয়স যখন তিন বছর তখন তিনি মায়ের পাশে বসে রান্নায় নানা রকম সাহায্য করতেন। তা ছাড়া তাদের বাসায় সব সময়ই বাঙালি খাবার রান্না করা হয়।

কামরুল চৌধুরী বলেন, 'আমার বাগানে আছে লাউ, শিম, টমাটো, আলু, বেগুন গাছ। অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট থাকলেও তাদের সাইনবোর্ডে লেখা থাকে ''ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট''। কিশোয়ারের এই বিশ্বব্যাপী সাফল্যে আশা করছি এখন অনেকেই ''বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট'' শব্দটি লিখতে আগ্রহী হবেন।'

অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেল ১০-এ গত ১২ বছর ধরে প্রচারিত হচ্ছে রিয়েলিটি শো 'মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া।' অস্ট্রেলিয়ান টিভি দর্শকদের ৯০ শতাংশের কাছে মাস্টারশেফ একটি অতি পছন্দের রিয়েলিটি শো। কেবল অস্ট্রেলিয়াতেই নয় এই শো এখন আন্তর্জাতিকভাবে দর্শকপ্রিয়। অস্ট্রেলিয়ার টেলিভিশনে প্রচারিত সব থেকে আলোচিত ও প্রশংসিত এই শো মূলত রন্ধনপ্রণালি বিষয়ক। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের সেরা রাঁধুনিরা বিভিন্ন ধাপ পার করে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য একের পর এক সুস্বাদু ও মুখরোচক পদ রান্না করেন।

অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী মাস্টারশেফের ১৩তম সিজনে অংশ নিয়ে সারা দুনিয়ার বাঙালিদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এই সময়ে দেশি এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে সম্ভবত কিশোয়ার চৌধুরীই একমাত্র বাঙালি নারী যার নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে এবং সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হচ্ছেন। তিনি মাস্টারশেফের মতো এমন একটি আন্তর্জাতিক মানের অভিজাত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রায় প্রতিটি এপিসোডে রান্না করেছেন একেবারে খাঁটি বাংলাদেশি খাবার। এটাই ছিল তার উপস্থাপনার সৌন্দর্য, তার চ্যালেঞ্জ এবং তার শক্তি।

অস্ট্রেলিয়ার তিন জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেফ অ্যান্ডি এলেন, মেলিসা লেয়ং ও জক জনফ্রিলো এই শোয়ের বিচারক হিসেবে কিশোয়ারের এই 'সাহস'কে বারবার অভিনন্দন জানিয়েছেন।

কিশোয়ারের পরিবার বহু বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় এলেও বাঙ্গালিয়ানা ধারণ করে আছেন মনেপ্রাণে। পারিবারিক এই প্রভাব কিশোয়ারকে বাঙালি রান্নার পদ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

কিশোয়ার চৌধুরী প্রায় প্রতিটি এপিসোডেই চিরায়ত বাঙালির মুখরোচক খাবার লাউ চিংড়ি, বেগুন ভর্তা, খিচুড়ি, মাছ ভাজা, ফুচকা, চটপটি, আলুর দম, আমের টক, খাসির রেজালা ও পরোটা পরিবেশন করে বিচারক ও বিভিন্ন ভাষাভাষীর নজর কেড়েছেন। তিনি বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার জুম্ম জনগোষ্ঠীর খাবারও রেখেছিলেন তার মেনু্যতে।

গত ১১ জুলাই সেমিফাইনালের 'সার্ভিস চ্যালেঞ্জ' ছিল এই প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বড় ধাপ। একটি পদ মাত্র এক ঘণ্টায় রান্না করে খাওয়াতে হবে ২৩ জন গ্রাহক, ২০ জন অতিথি এবং প্রতিযোগিতার তিন বিচারককে। এখানেও খুব দক্ষতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন কিশোয়ার। এই সার্ভিস চ্যালেঞ্জে তার সবচেয়ে মজার চমক ছিল ডেজার্ট। তিনি এখানে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরিবেশন করেন বাংলাদেশের মিষ্টি পান। সেই পান খেয়ে বিচারক মেলিসা বললেন, 'এটা বাংলাদেশের জন্য কিশোয়ারের প্রেমপত্র।'

কিশোয়ারকে এই প্রতিযোগিতার শুরুতে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এই প্রতিযোগিতা থেকে তার প্রত্যাশা কী? তখন তিনি বলেছিলেন, তিনি অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশের খাবারের প্রচলন করতে চান এবং বাংলাদেশি খাবারের ওপর একটা বই লিখতে চান। যাতে সহজেই যে কেউ বাংলা খাবার তৈরি করতে পারেন।

কিশোয়ার চৌধুরী প্রতিটি খাবার পরিবেশনের আগে বলছেন সেটি বাংলাদেশের কোন এলাকায় পাওয়া যায় এবং তিনি কার কাছে রান্নাটি শিখেছেন। প্রতিটি এপিসোডেই তিনি বারবার বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করেছেন। প্রতিবারই তার চোখ ভিজে গেছে, গলা ধরে এসেছে। এই বিষয়টিই সব বাংলাদেশি এবং বিচারকদের হৃদয় স্পর্শ করেছে।

কিশোয়ার চৌধুরীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল গ্র্যান্ড ফিনালে। আর এই এপিসোডে তার পরিবেশনা এখন দুনিয়া জুড়ে সবার মুখে মুখে। তিনি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এপিসোডে পান্তাভাত, শুকনো মরিচ পোড়া, আলু ভর্তা, কড়কড়ে মাছ ভাজি আর পেঁয়াজের সালাদ বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এটি ছিল তার এই জার্নির আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। সবাইকে অবাক করে তিন জন বিচারক ৩০ নম্বরের পুরোটাই দিয়ে দিলেন কিশোয়ারকে।

গত ১৩ জুলাই সব থেকে জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো-এর চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় কিশোয়ার দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়ে আলোড়ন তুললেন। কিশোয়ারই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি অস্ট্রেলিয়ার কোনো জনপ্রিয় রিয়েলিটি শোতে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন।

এর আগে ২০১৭ সালে মাস্টারশেফের সিজন ৯-এ অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান রাশেদুল হাসান। তিনি ছিলেন টপ টোয়েন্টি ফোর এবং মাত্র একটি এপিসোডের পরই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। তিনি পাকা সব রাঁধুনির সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারেননি।

কিশোয়ার একজন সুদক্ষ সেনাপতির মতো এই লড়াইটি লড়ে গেছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। ফাইনালে আসতে তাকে ৫৭টি এপিসোড পার করতে হয়েছে। এই ৫৭ এপিসোডের শু্যটিং চলেছে সাত মাস ধরে।

দুই সন্তানের জননী ৩৮ বছর বয়সি কিশোয়ার চৌধুরী মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে বাণিজ্যে স্নাতক এবং লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব আর্টস থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পেশায় তিনি একজন 'বিজনেস ডেভেলপার'।

রান্নাবান্নার প্রতি ঝোঁক এলো যেভাবে

কিশোয়ার চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ায় হলেও তার পারিবারিক আবহটা সবসময়ই ছিল বাঙালিয়ানা। কথায় কথায় জানালেন, তার বাবার বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরের আর মা কলকাতার বর্ধমানের। তারা দুজনে প্রায় ৫০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান।

তবে বিদেশে বসবাস করলেও নিজের দেশের ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা সবকিছুই বজায় রেখেছেন কিশোয়ারের বাবা-মা, আর সেটা তারা নিজের সন্তানদেরও ধারণ করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের বাগানে হার্বস থেকে শুরু করে শাক-সবজি মরিচ-লাউ সব কিছুই আমরা নিজেরা উৎপাদন করি। ছোটবেলা থেকে আমাদের বাবা-মা এসব কাজে আমাদের সম্পৃক্ত করেছেন'। কিশোয়ারের কখনো মনে হয়নি যে হঠাৎ করে তিনি রান্না শুরু করেছেন।

'যেগুলো সব সময় দেখে আসছি, করে আসছি, সেগুলোই রান্না করেছি। আমার বাবা মাছ ধরতে পছন্দ করেন, ছোটবেলায় তার সাথে মাছ ধরতে যেতাম। ওই যে ফ্রেশ মাছটা নিয়ে রান্না করা, সেটা দেখে বড় হয়েছি। আসলে এই পরিবেশটা সবসময় বাসার মধ্যেই ছিল'- আলাপকালে এভাবেই বলছিলেন কিশোয়ার।

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় যাত্রা

চিন্তাটা দুই সন্তানের মা কিশোয়ারের মাথায় আসে ২০২০ সালে সারা দুনিয়ার মতো অস্ট্রেলিয়াতেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর। 'গত বছরেই একটা বিষয় বারবার মনে হচ্ছিল যে আমার বাবা-মা যেরকম করে তাদের সংস্কৃতি, খাবার-দাবার সবকিছু আমাদের মধ্যে ইনস্টল করেছেন, আমি সেটা সন্তানদের মধ্যে করে দিতে পারব কিনা।

এটা শুধু আমার না, আমার মনে হয় দেশের বাইরে যেসব বাবা-মায়েরা থাকেন, সবার মধ্যেই এই চিন্তাটা থাকে'। আর এমন চিন্তা থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা বই লেখার পরিকল্পনা করেন কিশোয়ার।

'আমার ছেলের বয়স এখন ১২, এরকম একটা বয়সে নিজের সংস্কৃতি, পূর্ব-পুরুষ এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি সবসময় ভাবতাম ওদের জন্য কী রেখে যাওয়া যায়।'

তবে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় আবেদন করার কোনো ইচ্ছাই কখনো ছিল না কিশোয়ারের। তার ভাষায়, 'এটা আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল। সে আমাকে প্রায়ই বলতো মা তুমি এটা পারবা। তুমি অ্যাপস্নাই করো না কেন।

'আমার ছেলেকে আমি জুনিয়র মাস্টারশেফের জন্য চেষ্টা করতে বলছিলাম, কারণ সেও ভালো রান্না পারে। তারপর সে যখন বলছিল আমাকে অ্যাপস্নাই করতে, তখন ভাবলাম তাদের কাছে এক্সামপাল সেট করতে- একটা চেষ্টা করে আমি দেখতেই পারি।'

চার বছর বয়সি শিশুকন্যা সেরাফিনা ও বারো বছর বয়সি পুত্র মিকাইলের কথা ভেবে কিশোয়ারের এই চেষ্টায় যেন আরও গতি আসে। আর পাশে সবসময় ছিলেন তার পরিবার ও জীবনসঙ্গী এহতেশাম নেওয়াজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে