মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আইন অঙ্গনের দিকপাল দুই ব্যারিস্টার

দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে নারী আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। নারী এখন আর অবগুণ্ঠন আবৃত কোনো সত্ত্বা নয়। তাদের যোগ্যতা আর দক্ষতা এখন স্বীকৃত। আইন অঙ্গনেও উচ্চকিত বহু নারী। তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন ব্যারিস্টার ডক্টর রাবিয়া ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার সালমা সোবহান। আইন ও বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। দু'জন মহীয়সী নারী ব্যারিস্টারকে নিয়ে আজকের প্রতিবেদন। গ্রন্থনা করেছেন আবদুর রহমান মলিস্নক
নতুনধারা
  ০৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

রাবিয়া ভূঁইয়া

স্বাধীনতা উত্তর দেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার ডক্টর রাবিয়া ভূঁইয়া। নারী আইনজীবীদের জন্য যিনি মাইলস্টোন এবং নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। তার এ পথ চলায় পরিবারের সহযোগিতা পেলেও অসহযোগিতা পেয়েছেন বেশ কিছু সহকর্মীর কাছ থেকে। তবুও থেমে থাকেননি। একটু একটু করে আলোকিত করেছেন নিজেকে, আলোকিত হয়েছে সমাজ।

ব্যারিস্টার রাবিয়া ভূঁইয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৪ইং সালের ১ মার্চ, ঢাকা জেলায়। তার পিতা মরহুম আব্দুল হামিদ একজন নাম করা এবং নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছিলেন। মা ফিরোজা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। রাবিয়া ভূঁইয়া ঢাকার বাংলাবাজার গার্লস স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯৬০ সালে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে লজিক এ ডিস্টিংশন নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ৯ম স্থান অধিকার করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে অনার্সে প্রথম এবং ১৯৬৪ সালে এমএ (মাস্টার্স) দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে আইন পাস করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে ডিস্ট্র্রিক্ট বার এবং ১৯৬৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে সনদপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৩ সালে বার-এট-ল' পাস করে বাংলাদেশে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।

ডক্টর রাবিয়া ভূঁইয়া আপিল বিভাগেরও প্রথম নারী আইনজীবী। তিনি ১৯৭৩ সালে ব্রিটেনের লিংকন ইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার-এট-ল' ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৮৫-৮৭ সাল পর্যন্ত সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া। তিনি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অন্যতম আইনজীবী। সর্বোচ্চ আদালতে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী মামলা করেছেন- যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল জমিলা খাতুন বনাম রুস্তম আলী, যার ফলে মহিলারা এখন প্রাপ্য ভরনপোষণ পাচ্ছে। এছাড়াও গায়িকা রুনা লায়লা, ববিতাসহ বেশ কিছু উলেস্নখযোগ্য মামলায় লড়েছেন তিনি।

তিনি ১৯৮৯ সালে প্রথম ব্রিটিশ সিলেবাসের আদলে এলএলবি কোর্স (অনার্স) এর জন্য ভূঁইয়া একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করে আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। পাঁচশ'র বেশি শিক্ষার্থী বার-এট-ল' অর্জন করে আইনাঙ্গনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন।

আপিল বিভাগের আইনজীবী ও সাবেক মন্ত্রী ডক্টর ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক। পেয়েছেন ব্রিটেনের বিখ্যাত উপাধি 'ডক্টর অব লজ'। দেশ-বিদেশে নারীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান স্বরূপ তাকে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি এশিয়ার দ্বিতীয় এবং দেশের প্রথম নারী হিসেবে এ সম্মান অর্জন করেন।

এ সাফল্যের পথ একেবারে মসৃন ছিল না তার জন্য। পড়াশুনায় শ্বশুর বাড়ির বাধা থাকলেও স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন। সে সময় আদালতে পুরুষের পাশাপাশি কোনো নারী আইনজীবী প্রায় দেখাই যেত না। যুদ্ধ করেই নিজের জায়গা করে নিতে হয়েছে তাকে। প্রথম যেদিন আদালতে গেলেন, সেদিন সহকর্মীরা বিস্ময়ে আর অবহেলা ভরে তাকাচ্ছিলেন। রাবিয়া বসার জায়গা না পেয়ে পেছনে গিয়ে বসলেন এবং পেছন থেকে আওয়াজ তুলে বলেছিলেন 'মাই লর্ড আমার একটি মামলা আছে কার্যতালিকায়'। এমন আওয়াজ তুলে তিনি সাড়া জাগিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে তিনি ইংল্যান্ডের লিংকনস ইন স্টুডেন্ট ইউনিয়নে নির্বাচন করে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং তহবিল সংগ্রহের কাজ করেছেন তিনি। লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মিটিং ও মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। সেসময় তার পড়াশুনায় অনেক বাধা নেমে আসে।

সালমা সোবহান

স্বাধীনতাপূর্ব প্রথম নারী ব্যারিস্টার সালমা সোবহান (১৯৩৭-২০০৩)। যিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জেন্ডার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার মূল্যবোধের স্বপক্ষে বলিষ্ঠ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি একাধারে শিক্ষক, আইনবিদ, গবেষক, মানবাধিকারকর্মী, সমাজকর্মী, সর্বোপরি একজন মানবহিতৈষী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।

সালমা সোবহানের পুরো নাম সালমা রাশেদা আক্তার বানু। জন্ম ১৯৩৭ সালের আগস্টের ১১ তারিখে। তার বাবা মো. ইকরামুলস্নাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব। তার মা শায়েস্তা ইকরামুলস্নাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্যদের অন্যতম। তার মা-বাবা দু'জনই রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার শ্বশুরও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সালমা সোবহানের স্বামী বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তার তিন ছেলে হলেন, তৈমুর সোবহান, বাবর সোবহান ও জাফর সোবহান।

ইংল্যান্ডের ওয়েস্টনবার্ট স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু হয় সালমা সোবহানের। পরবর্তীকালে ১৯৫৮ সালে কেমব্রিজের গির্টন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে লিংকন'স ইন থেকে বার-এট-ল' সনদপ্রাপ্ত হন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬২ সালে। ১৯৫৮ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ব্যারিস্টারি ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবনের শুরুতেই ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের মেসার্স সারিজ অ্যান্ড বিচেনো ল' ফার্মে লিগ্যাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন সালমা সোবহান। ১৯৬২ সালে বিয়ে হওয়ার পর তিনি ঢাকা চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল' অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া)-র গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্ট ল' রিপোর্টসের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি এবং আরও ৮ জন মানবাধিকারকর্মীর সম্মিলিত প্রয়াসে গঠিত হয় মানবাধিকার সংগঠন 'আইন ও সালিশ কেন্দ্র' (আসক)। ১৯৮৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আসক-এ বিনা পারিশ্রমিকে নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। নারীদের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার নামে ?'সালমা সোবহান সাংবাদিকতা ফেলোশিপ' প্রদান করা হয়।

সালমা সোবহান ব্র্যাকের গ্রামীণ মহিলা সদস্যদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি এবং বিরোধ নিষ্পত্তির কাজে আধা-আইনজ্ঞদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি আইনি সাক্ষরতা কর্মসূচির পরিকল্পনা করেন। তিনি ও তার আটজন সহকর্মী মিলে ১৯৮৬ সালে গঠন করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। দীর্ঘ পনেরো বছর (১৯৮৬-২০০১) তিনি এই সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নেতৃত্বে এই সংস্থা একটি নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থায় পরিণত হয়। নারী অধিকার রক্ষায় তার অবদানের জন্য তিনি ২০০০ সালে ঢাকা 'অনন্যা' ম্যাগাজিন পুরস্কার এবং ২০০১ সালে নিউইয়র্ক ল' ইয়ার্স কমিটি ফর হিউম্যান রাইটস্‌ পুরস্কার লাভ করেন।

সালমা সোবহান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড, ব্র্যাক, নিজেরা করি প্রভৃতি সংস্থার পরিচালনা বোর্ডের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তিনি ২০০১ সালে ইউএন ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইউএনআরআইডি)-এর বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দ্য এশিয়া প্যাসিফিক উইমেন ল' অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, উইমেন লিভিং আন্ডার দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড এবং ম্যাচ কানাডা এই তিনটি আন্তর্জাতিক নারী সংস্থার সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এই নারী ২০০৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন।

তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে খবমধষ ঝঃধঃঁং ড়ভ ডড়সবহ রহ ইধহমষধফবংয-ইওখওঅ, (১৯৭৫) চবধংধহঃং চবৎপবঢ়ঃরড়হ ড়ভ খধ-িইজঅঈ (১৯৮১), এবং ঘড় ইবঃঃবৎ ঙঢ়ঃরড়হ ডড়সবহ ওহফঁংঃৎরধষ ডড়ৎশবৎং, (ঈড়- ধঁঃযড়ৎবফ), টচখ (১৯৯৮) উলেস্নখযোগ্য। এছাড়াও তিনি একটি উপন্যাস এবং তিনটি ছোট গল্প রচনা করেছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে