সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়েদের বিজয়ের ধারা অব্যাহত থাকুক

রূপম চক্রবর্ত্তী
  ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

গত ২৫ সেপ্টেম্বর, সোমবার এশিয়ান গেমসে পাকিস্তানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। পাকিস্তান নারী ক্রিকেট দলকে ৫ উইকেটে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জয়ের উলস্নাসে মেতে ওঠে বাংলার মেয়েরা। এই এশিয়ান গেমসে সাফল্যের ভারী পালস্না রয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ২০১০ ও ২০১৪ আসরে। তাদের ঝুলিতে রৌপ্যপদক পাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৯ নারী ক্রিকেট দল দক্ষিণ আফ্রিকায় নারীদের যুব বিশ্বকাপের প্রথম আসরে টানা দুই ম্যাচ জিতেছে। একটু যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখি অভিজ্ঞতার তুলনা করলে বাংলাদেশের এই অনূর্ধ্ব ১৯ নারী ক্রিকেট দলটির বেশির ভাগ সদস্যদের বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার খুব বেশ অভিজ্ঞতা ছিল না। অথচ সেখানে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পরে দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলংকাকে হারিয়েছে বাংলাদেশের এই নারী ক্রিকেট দলটি। প্রতিটি বিজয় কিন্তু আমাদের দেশের সম্মান বয়ে এনেছে। উইকেটকিপার নিগার সুলতানা মনে করেন, অবহেলিত নারী ক্রিকেটে মিডিয়ার ফোকাস ব্যাপকভাবে আসাটা জরুরি।

একটা সময় ছিল যখন আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রতিপক্ষ দলগুলোর কাছে বাংলাদেশ হারত ৬-৭ গোলে। এ দেশের মহিলা ফুটবল ছিল আঁতুড়ঘরে। ফুটবলারদের খেলা দেখে সবাই হাসাহাসি করত। আর এখন? মুগ্ধ হয়ে দেখে, তালি বাজায় এবং তাদের সমর্থনে গলা ফাটায়! এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। খেলোয়াড়রা বেসিক ফুটবল শিখেই আসে খেলতে। মহিলা ফুটবল উন্নতির সোপান বেয়ে ওপরে ওঠে যাচ্ছে তরতর করে। সেটা খুব দ্রম্নতই- যা বিস্ময়কর ব্যাপার। কিছুদিন আগে সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখেছি। বাংলাদেশের রুপনা চাকমা, আঁখি খাতুন, মাসুরা পারভীন, শিউলি আজিম, শামসুন্নাহার, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, কৃষ্ণা রানী সরকার, সাবিনা খাতুন, সিরাত জাহানরা অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ফাইনালে দুর্দান্ত খেলছে বাংলাদেশ নারী দল। বৃষ্টিভেজা কর্দমাক্ত মাঠে স্বাভাবিক নৈপুণ্য দেখাতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলে জয়লাভ করে বাংলাদেশ নারী দল। নেপালকে ৩ গোলে হারিয়ে সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছে।

আমাদের দেশে মেয়েদের খেলাধুলা করাটা মোটেও সহজ কোনো ব্যাপার নয়। কারণ অনেক জায়গায় মেয়েদের খেলার কোনো সুযোগই নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারা ফুটবল শিখতে চাইলেও বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষকদের তেমন উৎসাহ থাকে না। গ্রামের মাঠেও মেয়েরা খেলার জায়গা পায় না। অনেক মেয়ে আছে যারা জীবনে ফুটবল ধরারও সুযোগ পর্যন্ত পায়নি। এই রকম বহু প্রতিকূলতাকে জয় করে আমাদের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য। আমাদের জন্য তারা অনেকবার বিজয় এনেছেন। বিজয়ের আনন্দে ভেসেছে দেশ এবং দেশের মানুষ। মেয়েগুলো এমন এক সময়ে বিজয়ের আনন্দে আমাদের ভাসিয়ে দেন যখন আমরা আগামীদিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছিলাম। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে ধর্ষণের ভয়াবহ বার্তা ভেসে আসে। সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে প্রায়ই নারীদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন।

'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর'- নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বর্তমানে পুরুষের তুলনায় নারীও কোনো কাজে পিছিয়ে নেই। যদিও কয়েক দশক আগে কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা চোখে পড়ার মতো ছিল না। কিন্তু এখন নারীরা ঘরেবাইরে সব ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োজিত করছেন। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শুধু বিত্ত কিংবা মর্যাদার ফারাক নয় বরং নারী-পুরুষের ভেদাভেদও এক অবধারিত দুর্ভোগ। বাংলাদেশের নারীরা এখনো পশ্চাৎপদ সামাজিক অপসংস্কারে নিজেদের চলার পথকে সেভাবে নিঃসংশয় এবং নির্বিঘ্ন করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক অভিশাপ ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।

বিভিন্ন সংকটের মাঝেও মেয়েদের এগিয়ে চলা অবশ্যই আনন্দের সংবাদ। শিশু থেকে শুরু করে মধ্যবয়সি অনেক নারীরাই বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথে কিশোরীরা শিকার হচ্ছে ইভটিজিংয়ের- যার ফলে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শত শত মেয়ের শিক্ষাজীবন। এমনকি শিক্ষাজীবন শেষে একজন নারী যখন কর্মক্ষেত্রে পা রাখে সেখানেও তাকে ভুগতে হয় অনিরাপত্তায়, অনিশ্চয়তায়। একটা মেয়ে যদি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে তাহলে তাকে সব প্রতিবন্ধকতার সন্মুখীন হয়েই এগিয়ে যেতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে সমস্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমাদের সমাজের বেশির ভাগ নারীই দুর্বলচিত্তের অধিকারী। সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রত্যেক নারীকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, অন্যকেও অধিকার আদায়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং নিজেকে মূল্য দিতে শিখতে হবে।

শিক্ষকতা ও চিকিৎসক হিসেবে মেয়েরা কর্মজীবন শুরু করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। কিন্তু সময়ের অনিবার্য চাহিদায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদায় তাদের অভিষিক্ত হওয়াও এক অভাবনীয় নিদর্শন। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সচিব মর্যাদায় নিজেদের অংশীদারিত্ব প্রমাণ করতে তারা আর কিছুমাত্র ভাবছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রপ্তানি শিল্পে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ বিশ্বে নজর কাড়া। পোশাকশিল্প খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ অর্জিত হয়। পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। সেটা সবারই জানা। যেসব নারী দিনমজুর হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করে, তারা প্রতিনিয়তই মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়, সেই সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে তাদের কাজে নিয়োজিত রাখা এবং অন্যান্য মানসিক নিপীড়ন। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, নারী-পুরুষের সমকাজে সমান মজুরি প্রদানের কথা থাকলেও চারা রোপণ ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে পুরুষদের দৈনিক মজুরির চেয়ে নারীদের মজুরি অনেক কম। কিছুদিন আগেও আমরা চা শ্রমিকদের আন্দোলন দেখেছি। মাত্র ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি দিয়ে তাদের কাজ করানো হতো। এই চা শ্রমিকদের আন্দোলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সাড়া দিয়েছেন।

সচেতন এবং শুভ বুদ্ধির মানুষ চান ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও এগিয়ে যাক। নারীর অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে প্রথমে নারীর প্রতি সহিংসতা বা নির্যাতন বন্ধ করা। নানান পর্যায়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও নারী নির্যাতনের ঘটনা কমছে না। নিরাপত্তার অভাবে নারীর স্বাভাবিক চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে ও নারীকে তার কর্মক্ষেত্র থেকে পিছু হটতেও বাধ্য করে। সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে নারীসমাজকে যদি যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে পুরুষের মতো তারাও জাতি গঠনে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। একজন নারীর এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টা একটি পুরুষের মতো অতটা সাবলিল নয়। মাতৃত্ব, সন্তান, সংসার এবং পরিবার- এই বিষয়গুলোর সঙ্গে একজন নারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসবের জন্য একজন নারীকে অনেক কিছু সেক্রিফাইস করতে হয়।

দীর্ঘদিনের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, জীবনাচরণ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে ডিঙাতে গেলে অপেক্ষার অন্ত থাকে না। ততদিনে যা হওয়ার তাই ঘটে যায়। সমাজ সমস্যাকবলিত হয়, নারী নির্যাতন তার মাত্রাকে ছাড়ায়, তার চেয়ে বেশি মানবিক মূল্যবোধগুলোও বিপন্নতার আবর্তে পড়ে।

মানুষের মানবিক ও মানসিক শুদ্ধতা অত্যন্ত দরকার। মানুষের মর্যাদায় নারী-পুরুষের বিভাজনের ওপর আঁচড় বসাতে হবে। শুধু নারী নয়, মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্ত সম্মান তাকে দিতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও চিরতরে নির্মূল হয়নি যৌতুকপ্রথা- যা নিঃস্ব করে দেয় একটি অসহায় পরিবারকে। আবার, কখনো কখনো সরাসরি পাত্রপক্ষ যৌতুক দাবি না করলেও মেয়ের বাড়ি থেকে কিছু না দেওয়া হলে হেয় করা মেয়েটিকে। বিয়ের পর নানানভাবে কথা শুনতে হয় বাড়ির বউকে। আবার, অনেক সময় মেয়েদের বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিলেও বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি ভিন্নরূপ ধারণ করে। অন্যদিকে, বিয়ের পর একজন শিক্ষিত নারী চাকরি করতে চাইলে নানা দায়িত্বের বেড়াজালে রুদ্ধ করা হয় তার পথ। একটা পরিবারে অথবা সমাজে মেয়েদের বড় হওয়াটা ছেলেদের বড় হওয়ার চেয়ে আলাদা।

বেগম রোকেয়া নারী ও পুরুষ উভয়কে গাড়ির দুটি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। গাড়ির একটি চাকা না থাকলে কিংবা অকেজো হলে ওই গাড়িকে নিয়ে যেমন বেশি দূর এগোনো যায় না, ঠিক তেমনি নারী-পুরুষ সমান্তরালভাবে প্রগতির পথে না হাঁটলে সমাজের পরিবর্তন হয় না, সমাজ সামনের দিকে অগ্রসর হয় না। কয়েক বছর আগে হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলার কারণে জাতীয় দলের এক নারী ফুটবলারকে বাসে হেনস্তা হতে হয়েছিল। একই কারণে একজন নারী ফুটবলারের বাবাকে নিজের এলাকায় মারধর করা হয়। এই রকম অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের নারী খেলোয়াড়দের। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের তেঁতুলতলা গ্রামে বিভাগীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব অর্জন করা চার নারী ফুটবলারকে মারধর করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এই ঘটনা সত্যি বেদনাদায়ক। এই ঘটনায় সাদিয়া নাসরিন, মঙ্গলী বাগচী, হাজেরা খাতুন ও জুঁই মন্ডল আহত হয়। আহত মঙ্গলী বাগচী সংবাদ মাধ্যমে বলেন, 'তারা আমাকে আহত করে প্রায় দুই ঘণ্টা হাত বেঁধে আটকে রেখেছিল। তখন আমি অজ্ঞান ছিলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি চেয়ারের সঙ্গে আমার হাত বাঁধা। রক্তে আমার গা ভিজে গেছে।' নারী খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে খেলাধুলার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

অনেক সমস্যা মাথায় রেখে নারীদের খেলাধুলায় এগিয়ে যেতে হয়। একজন মেয়েকে এগিয়ে যেতে অবশ্যই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হয়। কারণ তাকে মায়ের ভূমিকা পালন করতে হয়, কোনো ঘরের বউয়ের ভূমিকায় থাকতে হয়, পাড়া-প্রতিবেশীর ঈর্ষণীয় দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে হয়, পরিবারের শাসন-বারণও থাকে। আবার সেই মেয়েকেই চাকরির ক্ষেত্রেও টিকে থাকার যুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু একটি ছেলেকে এত কিছু না সামলালেও চলে। তার প্রধান দায়িত্বই যেন নিজের ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করা। সেজন্য আমরা যারা নিজের অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত দাবি করতে পারি, তাদের অনেক প্রতিকূলতাকে সামলানোর মানসিকতা নিয়েই এগোতে হয়। এই প্রতিকূল পরিবেশ সাফ গেমসের মাঠেও দেখেছি। বৃষ্টিতে দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামের মাঠ কাদায় ছোপছাপ। যে মাঠে ভালো ফুটবল খেলা কঠিন। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের মেয়েরা দারুণ ফুটবল খেলে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায়। এত প্রতিকূল পরিবেশে যেভাবে আমাদের মেয়েরা খেলেছে ঠিক সেভাবে আরও এগিয়ে যেতে হবে। ফুটবল বলুন আর ক্রিকেট বলুন অথবা অন্য যে কোনো আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়দের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকুক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে