সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

একই মঞ্চে নারী চালক

কাজী ফারহানা
  ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

'ওমেন অন হুইল' হচ্ছে নারী ড্রাইভার অর্থাৎ যেসব নারী নিজস্ব গাড়ি চালায় বা চালাতে ইচ্ছুক তাদের একটি কমিউনিটি। আমাদের এ উদ্যোগের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, মেয়েদের জন্য ড্রাইভিংকে সহজ করে তোলা। মেয়েরা যত বেশি গাড়ি চালাবে, ততই সমাজের মানসিকতা বদলাবে এবং মেয়েদের জন্য বিদ্যমান যাতায়াত ব্যবস্থা আরও নিরাপদ হয়ে উঠবে। ড্রাইভিংকে মেয়েদের পেশা হিসেবে বেছে নিতেও উদ্বুদ্ধ করতে চাই। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে মেয়েদের ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায় কিনা, এটি নিয়েও ভাবতে হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে ওমেন ড্রাইভারস অ্যাসোসিয়েশন করার চিন্তা আছে আমাদের। পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে একটি ড্রাইভিং স্কুলও খুলব। তবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, নারীবান্ধব একটি অটোমোবাইল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে ড্রাইভিংয়ের পাশাপাশি মেয়েরা টেকনিশিয়ান হিসেবেও কাজ করার সুযোগ পাবে।

ফেসবুক গ্রম্নপের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। পেছনের গল্প বলতে গেলে নিজের কথা দিয়েই শুরু করি। আমি নিজে গাড়ি চালানো শুরু করি ২০১৬ সালে, সে সময় চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম। ড্রাইভিং শেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় আমার বাবাই আমাকে বিআরটিএর ট্রেনিং স্কুলে নিয়ে যান। শেখার পরে ভয়ের কারণে আর গাড়ি চালাইনি। ড্রাইভিং স্কুলের গাড়িগুলো সাধারণত একটু ভাঙাচোরা ধরনের হয়ে থাকে। ওই গাড়ি চালানোর পর নিজের বা বাসার গাড়ি চালাতে গেলে ভয়ই লাগে, নষ্ট হয়ে যায় কিনা। কিংবা বলা যায়, মেয়েদের ক্ষেত্রে গাড়ি চালানো একটু ভয়েরই ব্যাপার। এরপর বেশ কয়েক বছর গাড়ি চালানোর প্রয়োজন পড়েনি।

কিন্তু কোভিড-১৯ এসে যাওয়ার কারণে অফিসে আসা-যাওয়ার জন্য পাবলিক কোনো ট্রান্সপোর্ট ছিল না। খরচ কমানোর জন্য ড্রাইভারও বাদ দিতে হয়েছিল। ২০২০ সাল নাগাদ বিপদে পড়ে আবার গাড়ি চালানো শুরু করি। নিয়মিত গাড়ি চালানো শুরু করার পর দেখি, আসলে ভয় আমার নিজের মধ্যেই ছিল, ড্রাইভ করা তেমন কঠিন কাজ না। কিছুদিন যাওয়ার পর শুরু হলো অন্য সমস্যা। গাড়িবিষয়ক কোনো টেকনিক্যাল জ্ঞান আমার নেই। যার মাধ্যমে আমি গাড়ির যত্ন বা গাড়ির টেককেয়ার করতে পারি। এসব বিষয় তখন ভাই কিংবা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে হতো। অনলাইনেও এসব বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাই না।

আমাদের মেয়েদের জন্য গাড়িবিষয়ক কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে বিপরীত লিঙ্গের কারোর সাহায্য নিতে হতো। এ ছাড়া মেয়ে হিসেবে গাড়ি চালাচ্ছি, এটা নিয়ে সামাজিক বিভিন্ন অসুবিধায় তো পড়তামই। তখন অনুভব করলাম, আমার মতো যারা গাড়ি চালাচ্ছে, তারাও নিশ্চয়ই নানা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। কিংবা আমার চেয়ে ভালো জানে এমন অনেকেও তো থাকতে পারে। এ ভাবনা থেকে মনে হলো, এমন একটা পস্ন্যাটফর্ম বা গ্রম্নপ থাকা উচিত, যেখানে মেয়েরা গাড়ি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবে। এভাবেই মূলত শুরু।

প্রাথমিকভাবে আমার কাছের কয়েকজন বন্ধুকে বলি, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে, এটি দারুণ একটি আইডিয়া! সবাই মিলে তখন একটি মেসেঞ্জার গ্রম্নপ খুলি। ২০২০ সালের শেষদিকের কথা বলছি। গ্রম্নপের নাম কী দেব সেটি নিয়ে আলোচনা করি। কোনো নামই পছন্দ হচ্ছিল না। এভাবে বেশ কয়েক মাস চলে যায়। তখন একদিন মাথায় আসে 'ওমেন অন হুইল' সংক্ষিপ্ত আকারে 'ওয়াও' নামটি, এটি সবারই বেশ পছন্দ হয়। ২০২১ সালে মধ্যভাগে এ নামেই ফেসবুক গ্রম্নপের যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে নিজেদের বন্ধু এবং আগ্রহীদের গ্রম্নপে অ্যাড করার মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে যাই।

একই বছরের শেষ নাগাদ মনে হলো, সবাইকে অনুপ্রাণিত করার জন্য কিছু কাজ বা গল্প দরকার আমাদের। কারণ, আমি বিশ্বাস করি কোনো মেয়েই আসলে শখের বসে গাড়ি চালায় না, বিপদে পড়েই তাকে এ কাজে নামতে হয়। নিজের ট্রান্সপোর্ট নিজে চালালে আসলেই জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়, এ কথা জানানো প্রয়োজন। তখন নিজেদের গল্পগুলোই আমরা ভিডিও রেকর্ড করি। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের নারী দিবসে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে 'ওমেন অন হুইল'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক কিছুই কঠিন, আবার বেশ সহজও। আগে যখন আমি একা গাড়ি চালাতাম, তখন নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু এখন অনেকেই গাড়ি চালায়। একটি স্ট্রং কমিউনিটিও তৈরি হয়েছে। নিজেরা নিজেদের গল্পগুলোও জানি- যা নিজের জন্য যেমন গর্বের, অন্যের জন্য অনুপ্রেরণারও বটে। একজনের দেখাদেখি অনেকেই এগিয়ে আসছে। আমাদের গ্রম্নপে যোগ দিচ্ছে। এভাবে চিন্তা করলে বলব, অবশ্যই আমরা সফল হব। সেই পথেই আমরা আছি।

ওমেন অন হুইল মূলত একটি সামাজিক উদ্যোগ বা সংগঠন। এর সঙ্গে আমরা যারা যুক্ত আছি তারা কেউ চাকরিজীবী, কেউ উদ্যোক্তা, কেউ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। নিজেদের কাজের পাশাপাশি আমরা যতটুকু সময় বের করতে পারি, সেটা আন্তরিকভাবেই এখানে দেওয়ার চেষ্টা করি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে শুরু করা এ কাজটি করতে খারাপ লাগে না মোটেও। সাপ্তাহিক ছুটির ?দিনে কোথাও লং ড্রাইভে যাওয়া বা নিজেদের মধ্যে গাড়ির সমস্যা নিয়ে কথা বলা বেশ মজারও বটে।

প্রাথমিকভাবে আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম ্তকহড়ি ণড়ঁৎ ঈধৎ বা কণঈ, নিজের গাড়ি সম্পর্কে জানো। উদ্যোগটি নিয়েছিলাম গাড়ি সম্পর্কে কারিগরি জ্ঞান লাভের জন্য। এজন্য আমরা নিজেরা দেখা করা শুরু করি। কার গাড়ি কীভাবে চলছে, কোন কোন সমস্যায় পড়ছে কিংবা একেকটি গাড়ি একেক রকম, সেগুলো কীভাবে কাজ করে, কার মাইলেজ কত, কী করলে গাড়ি ভালো থাকে, কতদিন পর পর সার্ভিসিংয়ে নেওয়া উচিত ইত্যাদি এমন অনেক বিষয় আলোচনার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করতাম। পাশাপাশি আমরা কিছু বেসিক ট্রেনিংয়েরও আয়োজন করি। ট্রেনিংগুলোয় হাতেকলমে গাড়ির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শেখার সুযোগ থাকত।

আমাদের কমিউনিটির বন্ধন দৃঢ় করা জন্য মাসে অন্তত একবার মিট করা চেষ্টা করি এবং সবাই মিলে কাছে বা দূরে কোথাও যাই গাড়ি চালিয়ে এবং সেখানে গিয়ে ওপেন পার্কিং করে গাড়ি নিয়ে আলোচনা করি।

এসবের পাশাপাশি আমরা মেয়েদের ড্রাইভিং শেখানোর নতুন একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। আমাদের মধ্যে দক্ষ যারা, তারাই ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছি। এজন্য কিছু টাকাও নিচ্ছি। গত ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা ত্রিশজনের বেশি মেয়েকে গাড়ি চালনা শিখিয়েছি। কাজটা আমরা আরেকটু সহজ করার চিন্তা করছি। শহরের নানা প্রান্তে যদি আমাদের ট্রেইনার থাকে, তারা আশপাশের অনেককেই শেখাতে পারবে। এ বিষয়টা নিয়েই আপাতত কাজ করছি।

প্রাথমিক অবস্থায় ওমেন অন হুইলের অধিকাংশ সদস্যই কর্মজীবী নারী ছিলেন। ধীরে ধীরে অনেক ছাত্রী এবং গৃহিণীও যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন নারী সেলিব্রেটি, যারা নিজেরা গাড়ি চালায় এবং এসব সমস্যায় পড়েছে, তারাও আমাদের সদস্য। তারা এখান থেকে উপকার পাচ্ছে বলেই যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন অঙ্গনের পেশাজীবী নারী, যারা গাড়ি চালায় তাদের গল্পগুলো শুনতে চেয়েছি আমরা। একেকজনের গল্প একেক রকম। কিন্তু সব মিলিয়ে গল্পগুলো অন্য অনেকের জন্য অনুপ্রেরণারও বটে।

আমরা ওই অর্থে প্রচারণায় যাইনি। কোনো স্পন্সর অ্যাড দিইনি। নিজে থেকেই বড় হচ্ছে এই কমিউনিটি। একজন থেকে আরেকজন, এভাবেই আমাদের এগিয়ে চলা। এক বছরের পথচলায় গ্রম্নপে আটশরও বেশি সদস্য হওয়াকে আমি দারুণ সাফল্য হিসেবেই দেখছি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে নিজ উদ্যোগে আমাদের কাজ নিয়ে রিপোর্ট করেছে। এটিও সফলতার একটা অংশ। এ ছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকের 'তারা' উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি, এক বছরের ব্যবধানে এটিও কম সফলতা নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে