সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারী শাসক অহল্যাবাঈ হোলকার

তপন কুমার দাশ
  ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

এক অসীম সাহসী নারী শাসক অহল্যাবাঈ হোলকার। স্বামীর মৃতু্যর পর অপরিসীম দক্ষতায় সব রকমের অসন্তোষ, বিদ্রোহ দমন করে তিনি মালওয়ার রাজ্যের শাসনভার নিজ হাতে তুলে নেন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তিনি মালওয়ার শাসন করেন। এ সময়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রাচুর্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই রাজ্যের অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়। সেই পুরুষ শাসিত সমাজে অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া এই অহল্যাবাঈ শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। একজন সুদক্ষ শাসক হিসেবে দেশে-বিদেশে তার নাম আর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এ এক বিশাল ইতিহাস!

১৭২৪ সালে আহমেদ নগরের জামখেদ এলাকার চৌন্ডী গ্রামে অহল্যাবাঈ জন্মগ্রহণ করেন। তখন মারাঠা সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া নিষিদ্ধ থাকলেও সেবায়েত পিতার এ কন্যা বাল্যকালেই লেখাপড়ায় হাতে খড়ি নেন। এ সময় একদিন রাজা পেশোয়া বাজী রাওয়ের এক সেনাপতি মালওয়ারের শাসক মলস্নার রাও চৌন্ডী গ্রামে এসে মন্দিরে পূজারত এ কন্যাকে দেখে মুগ্ধ হন। তিনি তার দশ বছরের পুত্র খান্ডে রাওয়ের সঙ্গে মাত্র আট বছর বয়সি অহল্যার বিয়ে দেন।

১৯৫৪ সালে মুঘলদের অনুরোধে খান্ডে রাও কুমহের দুর্গ অবরোধ করেন। সে সময়ে এক যুদ্ধে তিনি নিহত হন। প্রথা অনুসারে খান্ডে রাওয়ের পত্নীরা সবাই সতীদাহে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু, অহল্যার শ্বশুর অহল্যাকে সতিদাহে যেতে বারণ করেন এবং রাজকার্যে মনোনিবেশ করতে নির্দেশ দেন। ১৭৬৬ সালে মলস্নার রাও মারা গেলে অহল্যার একমাত্র পুত্র মালে রাও হোলকারকে সিংহাসনে বসিয়ে অহল্যাই রাজকার্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। ১৯৬৭ সালের ৫ এপ্রিল মালে রাও হোলকারও মারা যান। তারপর অহল্যাবাঈ হোলকার নিজেই রানী হিসেবে নর্মদার তীরবর্তী মালওয়ারের শাসনভার গ্রহণ করেন।

কিন্তু অনেকেই এই নারী রাজত্ব মানতে পারল না। রাজ্যে শুরু হলো বিদ্রোহ, অশান্তি, গোলযোগ। এ সময়ে অহল্যাবাঈ রাজ্যের নিজস্ব সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ৫০০ নারী সৈন্যের এক দুর্ধর্ষ সৈন্যবাহিনী গঠন করেন এবং নিজে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কঠোর হস্তে অভ্যন্তরীণ সব গোলযোগ, বিদ্রোহ দমন করেন। অসি হাতে নিজেই তিনি যুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যেই মালওয়ারের দেওয়ান রানী অহল্যাবাঈয়ের বিরদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সে যশবন্ত সিং পেশোয়া রাঘবকে মালওয়ার আক্রমণ করতে আমন্ত্রণ জানান। অহল্যাবাঈও তার বাহিনী নিয়ে রাঘবকে প্রতিরোধ করেন। শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত রাজা রাঘব যুদ্ধ পরিহার করতে বাধ্য হন এবং তিনি মালওয়ারের আতিথ্য গ্রহণ করেন। রাজপুতদের সঙ্গেও যুদ্ধ করেন রানী অহল্যাবাঈ এবং রাজপুতরাও পিছু হটতে বাধ্য হন।

এ রকম অনেক আক্রমণ, হামলাই প্রতিহত করেন অহল্যা বিচক্ষণতার সঙ্গে। তিনি তুকোজি হোলকারকে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দেন এবং ইন্দোর থেকে রাজধানী স্থানান্তর করেন মহেশ্বরে।

নিজ রাজ্যে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়াও তিনি শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রাচুর্য ও প্রভাব প্রতিপত্তির দিক থেকে মালওয়ারকে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করেন। অহল্যাবাঈ হোলকার তার ত্রিশ বছরের শাসনামলে অযোধ্যা, মথুরা, রামেশ্বরসহ নানা স্থানে ধর্মশালা প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘলদের সঙ্গেও তিনি সদ্ভাব রক্ষা করেন। অহল্যাবাঈ শিল্প সাহিত্যের পরিচর্যা করতেন। শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মানুষের জন্য তার দুয়ার সব সময়েই খোলা ছিল। বিদ্বান এবং বিদ্যানুরাগীদের তিনি সম্মান করতেন, পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এ লক্ষ্যে তিনি বহু শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলেন। শিপ্রা নদীর তীরে তিনি গড়ে তোলেন দৃষ্টিনন্দন সব প্রতিষ্ঠান- যা স্থাপত্য কলায় যোগ করে নতুন মাত্রা। তিনি রাজ্যে কলকারখানা তৈরিতেও অবদান রাখেন। তিনিই সে এলাকায় প্রথম টেক্সটাইল কারখানা স্থাপন করেন।

তার শাসনামলে মালওয়ার সুখ-শান্তিতে ভরপুর ভারতবর্ষের এক সমৃদ্ধশালী অঞ্চলে পরিণত হয়।

এ মহীয়সী, দক্ষ ও কিংবদন্তি শাসকের এসব কীর্তির কথা ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। অনেক বিদেশি ঐতিহাসিক ও গবেষকের লেখায় উঠে আসে তার নাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলান নেহেরু রচিত 'ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া' বইয়ে উলেস্নখ করা হয়, 'ভারতবর্ষের ইতিহাসে শুধু একজন শ্রেষ্ঠ শাসকই ছিলেন না, ভারতবর্ষকে সামনে এগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন'। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার লিখেছেন, 'রানি হোলকার শুধু সে সময়ের নন, তিনি সর্বকালের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন'। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জন কেলী মহারানী হোলকারকে একজন দার্শনিক হিসেবে অভিহিত করেন। হায়দারাবাদের নিজাম লিখেছেন, 'কোন নারী শাসক এবং কোন পুরুষ শাসকই তার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন ছিল না'।

অন্যান্য অনেক গবেষকই লিখেছেন, রানী হোলকার হিন্দু ও মুসলিম প্রজাদের সুখ ও শান্তির জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রজাসাধারণের জলকষ্ট দূর করা, প্রশ্বস্ত রাস্তা নির্মাণ, ছায়াঘন বৃক্ষ রোপণ ইত্যাদি কাজের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ইতিহাস জুড়ে।

ভারত সরকারও তাকে প্রতিষ্ঠিত করেন মর্যাদার আসনে। তার নামে ইন্দোবের অদূরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেবী অহল্যাবাঈ হোলকার বিমানবন্দর। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরও নানাস্থানে বহু প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতি বছর তাকে স্মরণ করা হয়। তামিলনাড়ুর পাঠ্যপুস্তকসহ ভারতীয় সাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এই মহারানী অহল্যাবাঈ। ১৯৬৬ সাল তার নামে প্রকাশিত এক রাষ্ট্রীয় ডাক টিকিটে তার নাম লেখা হয়, 'হার হাইনেস্‌ মহারাণী শ্রীমন্ত অখন্ড সৌভাগ্যবতী অহল্যাবাঈ সাহিবা'।

১৯৯৫ সালের ১৩ আগস্ট ৭০ বছর বয়সে মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকার মারা যান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে