সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভোজ্যতেলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু সরিষার জাত

ড. মো. আব্দুল মালেক
  ০৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম ধরে ২০৩০ সালে ভোজ্যতেলের মোট দেশীয় চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় ২৮.০০ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভোজ্যতেল আমদানি করতে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি বছর ২০.০-২৫.০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। তেলজাতীয় ফসলের দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি ব্যয় কমানো সম্ভব। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২৪-'২৫ অর্থবছরের মধ্যে তেল ফসলের উৎপাদন ২৮.০ লাখ টনে উন্নীত করা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী সর্বশেষ ২০২০-'২১ অর্থ বছরে দেশে ১৩.৫৫ লাখ টন পামতেল এবং ৭.৮০ লাখ টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে অর্থাৎ সব মিলিয়ে আমদানি ২১.৩৬ লাখ টন এবং ব্যয় হয় ১৮৪.৭৯ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে মোট চাহিদা ২৪.০ লাখ মে. টনের বিপরীতে দেশে ভোজ্যতেল উৎপাদন মাত্র ৩.০ লাখ মে. টন, যা চাহিদার মাত্র ১২%।

'তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প'-এর মাধ্যমে জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৪০ ভাগ ভোজ্যতেল স্থানীয়ভাবেই উৎপাদনের কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন হচ্ছে, যার বেশির ভাগই সরিষা। ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা হ্রাস তথা দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে চাহিদার ৪০ শতাংশ পূরণে প্রয়োজন প্রায় ২৪.০ লাখ হেক্টর জমি তেলজাতীয় ফসল বিশেষ করে সরিষাকে প্রাধান্য দিয়ে আবাদের আওতায় আনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষাই প্রধান। এমন অবস্থায়, ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশে সরিষার চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানো, উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা অন্তর্ভুক্তিই একমাত্র উপায়। উলেস্নখ্য, ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার তেলে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ ৩০%-এর নিচে ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ ৫০%-এর উপরে এবং ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ এর অনুপাত ১:২ বিদ্যমান, যা পুরোপুরিভাবে স্বাস্থ্যসম্মত।

বাংলাদেশে আবাদকৃত তেলবীজ আবাদি জমির প্রায় ৬০% সরিষার আওতায় এবং কম-বেশি সব জেলাতেই সরিষার চাষ হয়। ডিএই সূত্রে জানা যায় দেশে গত ২০২১-'২২ অর্থ বছরে প্রায় ৬.০ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদে উৎপাদিত সরিষার পরিমাণ ছিল ৭.৩৫ লাখ মে. টন এবং গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরের সরিষার আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ে প্রায় ২.০ লাখ হেক্টর। ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষা তেলের চাহিদা বৃদ্ধি, অনুকূল আবহাওয়া, সরিষা আবাদে কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি ও উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা কৃষকপর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় চলতি অর্থ বছরে সরিষার উৎপাদনও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বৃদ্ধির কারণ। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক 'তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প'-এর আওতায় জুন ২০২৫ খ্রি.-এর মধ্যে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয়ের প্রত্যাশার অনুকূলে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০% দেশীয় উৎপাদন দিয়ে মিটানো সম্ভব হবে। ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশে তেলজাতীয় ফসল সরিষা চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ উচ্চফলনশীল জাতের দ্রম্নত সম্প্রসারণ ও উৎপাদন কলাকৌশলে আধুনিক পদ্ধতির অনুসরণই একমাত্র উপায়।

বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) মিউটেশন প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভাবন করেছে স্বল্প জীবনকালের উচ্চফলনশীল, প্রতিকূলতা সহনশীল ও সর্বাধিক জনপ্রিয় জাত বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১ ও বিনা সরিষা-১২ আর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত বারি সরিষা-১৪ ও বারি সরিষা-১৭ যেগুলোর জীবনকাল ৮০-৮৮ দিন এবং গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫-২.০ টন। প্রচলিত জাতের সরিষার স্থলে শুধু বিনা ও বারি উদ্ভাবিত সরিষার উলিস্নখিত জাতগুলো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দেশের সরিষা উৎপাদন অনেকাংশেই বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে সাধারণত আমনধান চাষের পর জমি পতিত থাকে এবং এর পরে সেই জমিতে বোরোধানের চাষ করা হয়। তেল উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজন আমনধানের পর জমি পতিত না রেখে স্বল্পমেয়াদি সরিষার আবাদ করা। এ জন্য দেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে স্বল্প জীবনকালের (১০০ থেকে ১২০ দিন) অথচ উচ্চফলনশীল আমনধানের জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলো মূল জমিতে চারা রোপণের মাত্র ৮০-৯৫ দিনের মধ্যেই সংগ্রহ করে ঘরে তোলা যায়। এরপর জমি পতিত না রেখে উন্নত জাতের সরিষা চাষ করা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলো ৮০-৮৫ দিনের মধ্যে পরিপক্ব হওয়ায় পরবর্তীতে একই জমিতে আবার বোরোধান চাষ করে প্রচলিত দুই ফসলী জমিকে তিন ফসলীতে রূপান্তর করা সম্ভব হচ্ছে।

শস্য বিন্যাসে বিনা উদ্ভাবিত বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১, বিনা সরিষা-১২, বারি সরিষা-১৪ ও বারি সরিষা-১৭ জাতের সরিষা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সাময়িক পতিত জমি সহজেই চাষের আওতায় আনা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রায় ২২.০ লাখ হে. জমি আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসের অন্তর্ভুক্ত (সূত্র : ডিএই)। স্বাভাবিক চাষাবাদ পদ্ধতিসহ শূন্যচাষ ও রিলে চাষ পদ্ধতিতে আবাদযোগ্য স্বল্প জীবনকালের বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১ ও বিনা সরিষা-১২ আবাদের মাধ্যমে উলিস্নখিত জমির অনেকটাই শস্য বিন্যাস পরিবর্তন করে আমন-সরিষা-বোরোধানে রূপান্তর করে অতিরিক্ত সরিষার উৎপাদন দিয়ে দেশীয় চাহিদার অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব।

দেশের প্রায় ১.৭ লাখ হেক্টর চরের পতিত জমিতে সরিষার আধুনিক ও প্রতিকূলতা সহনশীল (বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১ ও বিনা সরিষা-১২) জাতের সরিষা চাষের আওতায় এনে অতিরিক্ত প্রায় ২.২ লাখ টন সরিষা উৎপাদন করা সম্ভব।

বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলসহ অনেক জমিই এক ফসলী এবং ওইসব জমির অধিকাংশেই দীর্ঘ জীবনকালের আমনধান আবাদ হয়ে থাকে, ফলে আমনধান সংগ্রহ করতে হয় ডিসেম্বর মাসে এবং আমনধান সংগ্রহের পর সব জমি পতিত থাকে। নাবিতে বপনোপযোগী বিনা উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী এবং শূন্যচাষে বা প্রয়োজনে রিলে চাষ পদ্ধতিতে আবাদযোগ্য বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনা সরিষা-১২ ও বারি সরিষা-১৮ জাতগুলো সহজেই ওই এলাকায় সম্প্রসারণ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

বাংলাদেশে সরিষা বপন পরবর্তী অগ্রহায়ণ (মধ্য নভেম্বর হতে মধ্য ডিসেম্বর) মাসে নিম্নচাপজনিত বৃষ্টিপাতের কারণে জমিতে সাময়িক জলাবদ্ধতার কারণে দেশি জাতের সরিষা টরি-৭'সহ অন্যান্য উচ্চফলনশীল জাত নষ্ট হলেও বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯ এবং সম্প্রতি উদ্ভাবিত বিনাসরিষা-১২ জাতগুলো পাঁচদিন পর্যন্ত সাময়িক জলাবদ্ধতা/জলমগ্নতা সহিষ্ণু হওয়ায় কৃষকরা ফসলহানি হতে রক্ষা পাচ্ছেন।

কাজেই উচ্চফলনশীল ও স্বল্পমেয়াদি বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১, বিনাসরিষা-১২, বারি সরিষা-১৪ ও বারি সরিষা-১৭'সহ বারি সরিষা-১৮ জাতের আবাদ নিশ্চিতকরণ এবং শস্য বিন্যাসে উলিস্নখিত সরিষার জাতসমূহের অন্তর্ভুক্তকরণসহ পতিত জমি ও চরাঞ্চলে সরিষার জাতসমূহের আবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী ও সঠিক দিকনির্দেশনায় কৃষিবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ এবং সুযোগ্য কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের দক্ষ নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণে আগামী দুই বছরে দেশের ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমপক্ষে ৪০% কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অবশ্যই সম্ভব হবে। উলিস্নখিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বিনা ও বারি উদ্ভাবিত সরিষার জাতগুলো। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসি ও বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উন্নত জাতের মানসম্পন্ন বীজ পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন ও যথাসময়ে সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদানের পাশাপাশি ডিএই এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মাধ্যমে সরিষা চাষে কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ, সরিষার সঠিক চাষাবাদ পদ্ধতি বিষয়ে কৃষক ভাইদের অবহিতকরণ ও মাঠপর্যায়ে ডিএইর মনিটর জোরদার করা।

পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে