শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোথাও নেই বন্যা মির্জা

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৭ জুন ২০২১, ০০:০০

বন্যা মির্জা- মঞ্চনাটক দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর ছোটপর্দায় অনেক নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হন তিনি। কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেও সমালোচক মহলে আলোচিত হয়েছেন। মাঝখানে একটি নিউজ পোর্টালে হেড অব মার্কেটিং হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মঞ্চ, টিভি নাটক এমনকি চলচ্চিত্র- আপাতত কোথাও নেই তিনি। এর আগে বন্যা মির্জা বলেছিলেন, বছরে অন্তত একটা চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন। চাকরির সুবাদে সেটাও হয়ে ওঠেনি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে 'ঘর গেরস্তি' শিরোনামের একটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন তিনি। কিন্তু নানা কারণে চলচ্চিত্রটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সাম্প্রতিক সময়ে অভিনয়ে অনিয়মিত হওয়াসহ অনেক বিষয়েই যাযাদির সঙ্গে খোলামেলা কথা হয় বন্যা মির্জার। লম্বা কথামালায় নিজের অনেক ক্ষোভ, অভিমানের কথাও প্রকাশ্যে আনেন তিনি।

সাম্প্রতিক সময়ে অভিনয়ে তার অনিয়মিত হয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি অকর্ষণ করতেই অনেকটা অভিমানের সুরে বন্যা মির্জা বলেন, 'আপনি কি জানেন না, কেন আমি অনিয়মিত হয়ে পড়লাম? প্রশ্নটা বরং পরিচালকদের করলেই কি ভালো হয় না!'

খানিক থেমে আবারও একটানা কয়েকটি পাল্টা প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, 'আপনিও তো একজন সাংবাদিক। আপনার কি জানা নেই, আমি দীর্ঘদিন ধরে একটা চাকরি করছি! ফুলটাইম চাকরি করে আরেকটা ফুলটাইম কাজ করা যায়? যারা ব্যবসা করেন, এটা তাদের ক্ষেত্রে চলে। তা ছাড়া সিনেমার কথাই ধরুন। সিনেমা করব কোথায়? এখন কি সিনেমা হয়? প্রতি শুক্রবার হলে কি নতুন কোনো সিনেমা রিলিজ হচ্ছে?'

এখন বিনোদনের বহু পস্ন্যাটফর্ম এসে গেছে। দশ-বিশ বছর আগের পরিস্থিতি এখন আর নেই। পরিস্থিতি অনুযায়ীই পস্ন্যাটফর্ম বদলাচ্ছে। পরিস্থিতিও বদলাচ্ছে। এখন দর্শক আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে যখন ইচ্ছা তখন বিভিন্ন পস্ন্যাটফর্মে খুঁজে খুঁজে সিনেমা দেখছে। এই সুযোগ কিন্তু আগে ছিল না।

দর্শকের এত আগ্রহই যদি থাকবে, তাহলে দেশের সিনেমা হলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন? প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিস্মিত কণ্ঠে বন্যা মির্জা বলেন, 'কোন দেশের সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? বাংলাদেশের? সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার বহু কারণ আছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিটা কি আছে আদৌ? ওখানে কি সিনেমা বানানো হয়? এর জবাবে প্রথমেই জানতে হবে, সিনেমা বানানোর বদলে এফডিসিতে নানান ধরনের বিজ্ঞাপন শুটিং, রিয়েলিটি শো'র মতো অন্য বিষয়গুলো জায়গা করে নিয়েছে নাকি ইন্ডাস্ট্রিটাই অন্য কারো দখলে চলে গেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তো সিনেমা হল বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশে এটা হলো কেন? হলগুলো তো মালিকানাধীন। তারা মনে করছে, সিনেমার কোনো প্রোডাক্ট নেই, কাজেই হলের পরিবর্তে মার্কেট বানালে আরও বেশি লাভ, তাই সিনেমা হল বন্ধ করে দিচ্ছে। তবে হলগুলো কেন বন্ধ হচ্ছে, এটা জানতে হলে আরো অনেক কিছু খতিয়ে দেখার আছে।'

এখন তো মানুষের কাজের পরিস্থিতি অনুযায়ী তার উপায়গুলোও দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এমনকি আগের এক ফসলির বদলে দু'তিন ফসলি চাষেও দু'তিনগুণ বেশি সময় দিতে হচ্ছে। মানুষের টাকা উপার্জনটাই এখন প্রধান বিনোদন। দু'তিন ঘণ্টা হলে বসে থাকার মতো সময়ও নেই কারও। আগে যেমন মানুষ একবেলা বিনোদনের জন্য রাখতো... প্রসঙ্গ শেষ করার আগেই কথা কেড়ে নিয়ে বন্যা বলতে শুরু করেন, 'আপনি কোন বাংলাদেশের কথা বলছেন যে, একসময় দর্শক একবেলা বিনোদনের জন্য রাখতো? আমি মনে করি না দেশের মানুষ একবেলা কাজ করতো আর একবেলা বিনোদনের জন্য রাখত। কাজের বহু উপায় ও ব্যস্ততা বেড়ে গেছে, এটাও মনে করি না। এখনও বহু মানুষ কাজের খোঁজে বেকার আছে।'

তার মানে কাজ খোঁজা বেকাররাই ওই উপচে পড়া দর্শক? প্রযুক্তি ও বিনোদনের নানা পস্ন্যাটফর্মগুলো কিন্তু বর্তমান কর্মজীবীদের পরিস্থিতির কথা ভেবেই হয়েছে। ফের পাল্টা প্রশ্ন তুলে বন্যার ব্যাখ্যা, 'আপনি বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে সিনেমা ধরে নিলে প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু একমাত্র মাধ্যম তো বিনোদন না। আর মানুষের আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গেও এটা যুক্ত নয়। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, আগের মতো দর্শক টানতে চাইলে হলগুলোও মানসম্মত করতে হবে। তারপরও কথা থাকে, যদি সিনেপেস্নক্সের মতো উচ্চমানসম্পন্ন হল হয়, তাহলে সেখানে শ্রমজীবীরা বসতে পারবেন? আপনার আমার মতো দর্শক শ্রমজীবীদের পাশে বসে একসঙ্গে সিনেমা দেখার আগ্রহ রাখবেন? যদি শ্রমজীবীদের পাশে বসে সিনেমা দেখার মনমানসিকতা থাকে আমাদের, তাহলে বিষয় কিন্তু একটি না। অনেকগুলো। কাজেই এখানে একটি মাত্র বিষয় দিয়ে বড় বিষয় পর্যালোচনা করা সম্ভবও নয়। তাহলে এক্ষেতে আমাদের নির্মাতাদের মধ্যে কি সীমাবদ্ধতা আছে? এটার জবাবে বন্যা বলেন, আমাদের সবারই দক্ষতার অভাব রয়েছে, বিভিন্ন বিষয়ে। সীমাবদ্ধতা আমাদের সবার মধ্যেই কমবেশি আছে। শুধু নির্মাতা ও কলাকুশলীদের সীমাবদ্ধতা আছে, এমন কথা বলব কেন? টেকনেশিয়ান থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রী সবারই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অবশ্যই আমাদের সবারই দক্ষতার অভাব রয়েছে। দুয়েকজন দক্ষ লোকে নিয়ে তো পুরো ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না।'

এমন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আর্টফিল্ম আলোচনায় থাকে, কিন্তু সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখে বা দর্শককে সচল রাখে বাণিজ্যিক ধারার সিনেমাই। এখন কিন্তু সেই বাণিজ্যিক সিনেমারও দর্শক নেই। এর কারণ কি জানতে চাইলে বন্যা বলেন, 'আর্টফিল্মও তো দর্শক দেখছে, নয় তো আর্টফিল্ম টিকছে কি করে? আসলে এখনকার নির্মাতাদের ওপরই দর্শকদের কোনো আস্থা নেই। দর্শক কেন নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে একই সিনেমা বারবার দেখতে যাবে? কাজেই নিয়মিত সিনেমা বানাতে হবে। দশটা সিনেমা বানানো হলে দু'টো সিনেমাও তো উপচে পড়া দর্শক হওয়ার মতো হবেই। কিন্তু এখন যারা সিনেমা বানাচ্ছেন, তারা কী মনে করেন এই সিনেমা সবার জন্য প্রযোজ্য?'

এমন প্রেক্ষাপটে নির্মাতাদের ব্যর্থতায় বাংলা সিনেমা হারিয়ে যাওয়ার জন্যও একটা অশনি সংকেত কিনা, এর জবাবে বন্যা বলেন- 'এই অশনি সংকেত এখন শুরু হয়েছে?' প্রশ্ন ছুড়ে বন্যা বলেন, 'এই অশনি সংকেতের কথা তো বিশ বছর আগে থেকেই আমরা শুনে আসছি। বর্তমানের অন্যান্য পস্ন্যাটফর্মগুলো আসার অনেক আগে থেকেই মানুষ হলবিমুখ হওয়া শুরু করে। অন্যান্য পস্ন্যাটফর্মগুলো আসার অনেক আগেই বাংলা সিনেমার ক্ষতি হওয়া শুরু হয়। এখন কি কোনো নির্মাতা উপচে পড়া দর্শকের জন্য সিনেমা বানায়? দর্শকের তো দায় নেই যে, নির্মাতা যেমন সিনেমা বানাবেন তেমন সিনেমাই দশর্ক দেখবেন। তবে বাংলাদেশে সিনেমা বা হল কোনো সমস্যা নয়, বরং সমস্যা রয়েছে আরও অন্যান্য জায়গায়। সেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত না করে সিনেমায় কেন দর্শক নেই- এই প্রশ্নের কোনো সুরাহা হবে না। আমি মনে করি, ইন্ডাস্ট্রিটাকে সিনেমা বানানোর পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। নিয়মিত সিনেমা বানাতে হবে। অর্থ লগ্নি করতে হবে। প্রতি শুক্রবার হলগুলোতে সিনেমা রিলিজ দিতে হবে। তাহলেই আবার সেই উপচে পড়া দর্শক দেখা যাবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে