শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসে আরিফিন শুভ

ম তারার মেলা রিপোর্ট
  ২৬ মে ২০২২, ০০:০০

শুটিং শুরুর কথা ছিল অনেক আগে। কিন্তু বাদ সেধেছিল বৈশ্বিক মহামারি করোনা। পরিস্থিতি একটু ভালো হতেই পুরোদমে কাজ শুরু করে করে দেন ৮৬ বছর বয়েসি পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এবং দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারজয়ী ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। গত বছরের প্রথম মাসের শেষদিকে ক্যামেরা ওপেন হয় বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র 'মুজিব : একটি জাতির রূপকার'-এর। ভারতের রাজধানী মুম্বাইয়ের শহরতলির দাদাসাহেব ফালকে 'চিত্রনগরী'তেই শুরু হয় বহুপ্রতীক্ষিত বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনার এই চলচ্চিত্রের। বেশ কয়েকটি লোকেশনে তৈরি করা হয় সেট। কোথাও টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর ঘাট বা ফুটবল খেলার মাঠ, কোথাও আবার শেখ মুজিবের স্মৃতিবিজড়িত কলকাতার বেকার হোস্টেল। এরপর বাংলাদেশ এবং পরবর্তীতে আবার ভারতে চলে এর দৃশ্য ধারণের কাজ। এই চলচ্চিত্রের দৃশ্য ধারণের কাজ শেষ হয় চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝিতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে সিনেমা নির্মাণ হলেও স্বাধীনতার এত বছর পরেও বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে নিয়ে নির্মিত হয়নি কোনো চলচ্চিত্র। অবশেষে এতদিন পর সেলুলয়েডে আসেন 'বঙ্গবন্ধু'। এটা জাতির জন্য গর্বেরও বটে। বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় ডাবিংকৃত সিনেমাটি দেখতে পাবেন দর্শক।

আলোচিত এই চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অভিনেতা আরিফিন শুভ। এমন একটি ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয় করা একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। অনুভূতিটাও অন্যরকম। এ নিয়ে শুভ বলেন, 'যখন শুনলাম বঙ্গবন্ধু চরিত্রের জন্য আমি নির্বাচিত হয়েছি। এটা শোনার পর সবার সামনে চোখে পানি আসেনি। কিন্তু আড়াল হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে চোখ দিয়ে পানি ঝরেছে। সেটা আনন্দ অশ্রম্ন। মানুষ যখন এক্সট্রিম হ্যাপি হয়, সেটা প্রকাশ করার ভাষা থাকে না। পার্থিব জগতের যত সুখ বা প্রাপ্তি, সেগুলো মানুষ প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু এই প্রাপ্তিটা পার্থিব জগতের অনেক উপরে- যেটা প্রকাশ করার কোনো ভাষা জানা থাকার কথা নয়।'

শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে দোয়া নেন শুভ। সেটিও কম ভালো লাগার বিষয় নয়। শুভ বলেন, 'উনি ওনার বাবা সম্পর্কে অনেক কিছু বলেন। সিনেমাটির জন্য যতগুলো ওয়ার্কশপ করেছিলাম, সেটার চেয়ে ওনার সঙ্গে দেখা হওয়ার অল্প মুহূর্তটায় জানা বিষয়গুলোর জন্য কাজ করতে অনেক বেশি সহায়ক হয়েছে। যখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, 'শুভ আমার বাবার চরিত্রটা ভালো করে কোরো, তখন উত্তরে আমি বলেছি দোয়া করবেন।' সে দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসছে, তিন-চার ঘণ্টা আমাদের সঙ্গে আলাপ করার পর প্রধানমন্ত্রী যখন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, সবাই ওনাকে ঘিরে রেখেছিল। আমি ওনাকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আর ওই দৃশ্যটা আমি মনের কোণে বেঁধে রাখার চেষ্টা করছিলাম। একদম যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন উনি আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না, হাসি দিয়ে ডাক দিলেন, 'আমার আব্বা কই?' তারপর আমি সামনে এগিয়ে গেলাম, আবারও দোয়া চাইলাম। বললেন, 'মন দিয়ে কোরো।' এইটুকুই সারাজীবনে আগলে রাখার মতো সম্পত্তি আমার। এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সব থেকে বড় সম্পত্তি এটা।'

এই চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের আগে শুভ নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে কিছুটা শারীরিকভাবে দুর্বল থাকলেও মনের জোর ও আলস্নাহ্‌?র রহমত নিয়ে কাজ শুরু করেন বলে জানান এই অভিনেতা। তবে তার আগে এই চরিত্রটির জন্য তাকে জুতসই প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। আরিফিন শুভ বলেন, 'শুটিংয়ের আগে তিন মাসে দেশে-বিদেশে মিলিয়ে চার থেকে পাঁচবার আমি অডিশন দিয়েছি। পরে আমাকে কনফারমেশন দেওয়া হয়। তখন থেকে শুটিং শুরুর আগ পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব হয়েছে জাতির পিতাকে পড়া, ওনার ফুটেজ দেখা, ওনার সম্পর্কে শোনার অনেক চেষ্টা করেছি। যারা ওনাকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের কাছে ১৯২০ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। এরপর ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে কয়েকদিন আমার শেষ ওয়ার্কশপ হয়।'

বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে নিজেকে তুলে ধরাটা যে কোনো অভিনয়শিল্পীর জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ। আরেফিন শুভ দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক চরিত্রে নিজেকে প্রমাণ করলেও এটার সঙ্গে কোনো চরিত্রের তুলনা হয় না। চ্যালেঞ্জিং এই চরিত্রটি নিয়ে এই অভিনেতা বলেন, 'যখন কারো সঙ্গে প্রেম হয়ে যায়, তখন সে অন্ধ হয়ে যায়। কথায় আছে- প্রেমেতে অন্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলে যে মানুষটা, আমি তার প্রেমে পড়ে গেছি। আর প্রেম হয়ে গেলে চ্যালেঞ্জটা আসে না। ওনার আদর্শকে উপজীব্য করে কাজটা সর্বস্ব দিয়ে করার চেষ্টা করেছি।'

প্রতিটি নতুন চরিত্রে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। অভিনয়শিল্পী সেই অভিজ্ঞতা পুষে রাখেন। বঙ্গবন্ধু চরিত্রে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা ছিল আরেফির শুভর জন্য একেবারেই আলাদা। তিনি বলেন, 'শুটিংয়ের প্রথম সাড়ে তিন মাস মুম্বাইতে, তারপর দেড় মাস ঢাকায়, শেষের ১০ দিন আবার মুম্বাইতে। মুম্বাই, তারপর ঢাকা, তারপর আবার মুম্বাই- এই পুরো সময়টাতে আমাকে ভিন্ন একটা আবহের মধ্যে রাখা হয়েছে। যে হোটেলে ছিলাম সেখানে আমি ভিন্ন একটি ফ্লোরে ছিলাম। যেখানে অন্য কেউ ছিল না। সেই রুমে আমি বঙ্গবন্ধুর ছবি লাগিয়ে ছিলাম। সেখানেই আমার ভাবনাগুলো ছবির মধ্যে লিখে রাখতাম। প্রথমে শুটিং সেটে, সেখান থেকে ফিরে আবার রুমে সেই আবহের মধ্যেই ছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, এই সময়টাতে কোনোভাবেই বের হতে পারব না। এমনকি কারও সঙ্গে আড্ডা মারা বা ঘুরতে যেতে পারব না। আমিও সেই আবহের বাইরে যেতে চাইনি। শুটিংয়ের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করার চেষ্টা করেছি।' ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'মুজিব:একটি জাতির রূপকার' চলচ্চিত্রের ট্রেলার প্রকাশ পেয়েছে। আরেফিন শুভও সে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। হেঁটেছেন রেড কার্পেটে। এই নিয়ে তিনি বলেন, 'স্বপ্ন ছোঁয়ার মতো অনুভূতি কাজ করেছে। আমার মাথায় একটা বিষয়ই ঘুরছিল, ১৭-১৮ বছর আগে ২৫৭ টাকা নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসা ছেলেটি কানের রেড কার্পেটে হাঁটছে। তার মানে আমার ওপর মানুষের ভালোবাসা, দোয়া এবং আস্থা আছে। বিষয়টি আমাকে অনুপ্রাণিত করছে আরও ভালো কাজ করার, যাতে ভবিষ্যতে আবারও কাজ নিয়ে এখানে আসতে পারি।

৩৫ কোটি টাকা বাজেটে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক। এই বাজেটের ৬০ ভাগ দিয়েছে বাংলাদেশ ও ৪০ ভাগ ভারত। বায়োপিকটি নির্মাণে শ্যাম বেনেগালের সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন দয়াল নিহালানি। চিত্রনাট্য করেছেন অতুল তিওয়ারি ও শামা জায়েদি। শিল্প নির্দেশনার দায়িত্ব পেয়েছেন নীতিশ রায়। কস্টিউম ডিরেক্টর হিসেবে আছেন শ্যাম বেনেগালের মেয়ে পিয়া বেনেগাল। জানা গেছে, এই বায়োপিকে উঠে আসবে বাংলাদেশের অভু্যদয় থেকে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের নির্মম ট্র্যাজেডি। তারুণ্য থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পরবর্তী সময়ের মুজিবের দেখা মিলবে চলচ্চিত্রে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে