রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

দীপ্তিময় দ্বীপান্বিতা

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
দ্বীপান্বিতা মার্টিন

সেই ছোটবেলা থেকেই অভিনয় করে আসছেন রোজালিন দ্বীপান্বিতা মার্টিন। তাও যেখানে সেখানে নয়, অভিনয়ের সবচেয়ে আসল বুনিয়াদি শিক্ষা হয় যেখানে সেই থিয়েটারে অভিনয়ের হাতেখড়ি তার। স্কুলে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়েই অভিনয়ে আসেন তিনি। নাম লেখান ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতেই। সেই সুবাদে অভিনয়ে একটা বুনিয়াদি শিক্ষা আছে তার। ওই বয়সেই পা রাখেন ছোটপর্দায়। নাগরিক নাট্যাঙ্গনের 'চাঁদবণিকের পালা', দেশ নাটকের 'নিত্যপুরাণ', মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের গল্প নিয়ে 'বিরসা কাব্য'তে অভিনয় করেন। এক সময় তিনি বাসিন্দা হয়ে যান চলচ্চিত্রের। দ্বীপান্বিতা অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র বেলাল আহমেদের 'মাটির জাহাজ'। ২০০৭-০৮ সালে নির্মিত হলেও চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়নি।

থিয়েটার ও ছোটপর্দা মিলিয়ে অভিনয়ের ক্যারিয়ার কম নয় দীপান্বিতার। ২০১৮ সালে চারুনীড়ম কাহিনী চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী নির্বাচিত হওয়া ছাড়াও আলোচনায় আসেন 'গোল্ডেন এ পস্নাস' দিয়ে। ক্যারিয়ার অনেক লম্বা সময়ের হলে কী, অভিনয়ের জন্য দ্বীপান্বিতাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বঞ্চনার শিকারও হতে হয়েছে পদে পদে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কাজ করা হয়নি তার। এ নিয়ে একটা আক্ষেপ আছে দ্বীপান্বিতার। পরিচালকরা দোহাই দেন তাকে কাস্ট করা হলে প্রোডাকশন হাউস বা চ্যানেলগুলো সে নাটক কিনতে চাইবে না। এমন অজুহাতের কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। তারপরও হাল ছাড়েননি। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছেন নিজেকে প্রমাণের। এ নিয়ে যায়যায়দিনকে দ্বীপান্বিতা বলেন, 'আমাকে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। অনেক ফ্রাসটেশনের মধ্যে দিয়ে সময় কাটাতে হয়েছে। যদিও আমার অনেক রকমের চরিত্রে অভিনয় করার যোগ্যতা আছে। একজন ক্যারেক্টার আর্টিস্ট নায়িকা চরিত্রেও ভালো করবেন। যিনি অভিনয় পারেন নায়ক-নায়িকাও হতে পারেন। কারণ, সব চরিত্রেই সবাইকে প্রথম ক্যারেক্টার আর্টিস্টই হতে হয়। তবে এখন দিন বদলাচ্ছে। চলচ্চিত্রের ধারা বদলাচ্ছে। মাঝখানে এর মূল্যায়ন হতো না। সেই খারাপ সময়গুলো পেরিয়ে এসেছি। এখন হাওয়া বদল হচ্ছে। এখন নায়কা-নায়িকা নয়, সব জায়গাতে চরিত্রই প্রধান হয়ে উঠছে।'

এই দিনটির জন্যই অপেক্ষা করতে হয়েছে তার দিনের পর দিন। যারা গস্ন্যামার দিয়েই সব দখল করে নেন সে অভিনেত্রী তো তিনি নন। সেজন্য গোটা অভিনয় জীবনে ভেবেছেন শুধু চরিত্র নিয়েই। কোন চরিত্র হুবহু ফুটিয়ে তুলতে পারবেন এ নিয়েই কাটিয়েছেন গোটা অভিনয় জীবন। তারপও কি তার মনে এমন ভাবনা হয় না- একজন নায়িকার গস্নামার না থাকলে তাকে নায়িকাই মনে হয় না? এমন প্রশ্নে দ্বীপান্বিতা এক গাল হাসি দিয়ে বলেন, 'কেউ যদি গস্ন্যামারার্স নায়িকা হতে চান তো সেটা একপর্যায়ে দরকারই। তবে সেটা যারা দর্শক তাদের জন্যই। কিন্তু গল্পে নায়িকার পরিচয় যেমন পাওয়া যায় তেমন তো সব চলচ্চিত্রে আসে না। যেমন ধরেন, আমি সবসময়েই টানাপড়েনের মধ্যে থাকা একটা পরিবারের জীবন বদলে দিচ্ছি, সেখানে আমি কি নায়িকা নই? এই মেয়েটি গস্ন্যামারার্স না হয়ে একেবারে সাদামাটা বা অর্ডিনারিও তো হতে পারেন। তবে এভাবে কম গল্পেই সেরকম কোনো নায়িকাকে দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, অভিনয়টিই বড়- তারপরেই আসে গস্ন্যামার।' দ্বীপান্বিতার এ কথাটি কতটা সত্য সেটা বোঝা যাবে এই ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতেও এমন লাস্যময়ী নায়িকা ছিলেন যারা দর্শকের হৃদয়ে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছেন, অনেক সিনেমা করেছেন কিন্তু জীবনে একটি সিনেমার জন্যও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেননি। আর দ্বীপান্বিতা মাত্র দু'টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেই গাজী রাকায়েতের 'গোর' সিনেমায় ২০২০ সালের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন।

এরপর থেকে চলচ্চিত্রে তার গুরুত্ব রাতারাতি বেড়ে যায়। যে কারণে ২০২২ সালে একসঙ্গে বেশ কয়টি সিনেমার কাজ পান। 'শিমু' (মুক্তিপ্রাপ্ত-২০২২), 'পায়ের তলায় মাটি নেই', 'মানুষের বাগান', 'পাতালঘর', 'কাঁঠাল', 'রিপলস', 'পায়ের ছাপ' ও 'চাঁদের অমাবশ্যা' প্রভৃতি।

অভিনয়ও করে যাচ্ছেন এমন চলচ্চিত্রে যেখানে দর্শকের অন্যতম প্রধান আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পারেন। এর মধ্যে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালিউলস্নাহ্‌র 'চাঁদের অমাবস্যা' অবলম্বনে করা সিনেমার প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। যে থিমটি গোটা উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আবর্তিত হতে থাকে। ওটিটি পস্ন্যাটফর্মেও তার অভিনয় বেশ যুৎসই হয়ে উঠছে। এখানে চরিত্রকে গুরুত্ব দিয়ে কন্টেন্ট বানায় বলে দ্বীপান্বিতা তার কাঙ্ক্ষিত জায়গাটিই খুঁজে পেলেন। তানিম নূরের ওয়েব সিরিজ 'কাইজার'-এ দর্শক তাকে চিনতে পারে একেবারেই ভিন্ন পরিচয়ে। মুনিরা চরিত্রে যা করেছেন এক কথায় অনবদ্য। গোটা সিরিজের আলো তার দিকেই আকর্ষিত হয়েছে। 'একাত্তর' ও 'নিখোঁজ' সিরিজে যা চেনাতে পারেনি সেটাই চেনাল 'কাইজার'।

কিন্তু এ গল্পে দীপান্বিতার চরিত্রটি কী? সহাস্যে দীপান্বিতা বলেন, 'মানুষের জীবনাচারে হোক বা গল্পেই হোক, প্রতিটি চরিত্রেরই যার যে কাজ, তার পেছনে একটা যোগসূত্র থাকে। তা যেমনই হোক চরিত্রটি, জানে সে যা করছে তা ঠিক কাজটাই করছে। সেই চরিত্রগুলোরই কোনোটা আমাদের বিচারে নায়িকা কিংবা কোনোটা ভিলেন।

এখন বিশ্বব্যাপী যে কাজগুলো ফোকাস করা হচ্ছে, সেগুলো চরিত্রভিত্তিক। একটি চরিত্র গল্পে কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে কে নায়িকা, কে নায়িকা নয়। কে নায়ক, কে নায়ক নয়।' এমন চরিত্রের জন্যই কি এতকাল অপেক্ষায় ছিলেন? এটা স্বীকার করেই দ্বীপান্বিতা বলেন, 'আসলে সেই ছোটবেলা থেকেই তো এই অভিনয়টা করে আসছি।

তারপরও চরিত্রের নাম ধরে সাধারণ মানুষ আমাকে খুব কম ডেকেছে। আমি তো জাতীয় পর্যায়ে অতটা পরিচিত না। এখন ভালো লাগছে এটা ভেবে যে, দর্শক যখন আমাকে দূর থেকে মুনিরা নামে ডাকে। তখন প্রাণটা ভরে যায়। এতদিনে মনে হয় আমার অভিনয় জীবনটাও স্বার্থক হয়েছে।' তার মানে দ্বীপান্বিতার মনের মুকুরে সুপ্ত হয়ে আছে সেটা 'নায়িকা'ই। নায়িকারূপেই আলোকিত হতে চান দ্বীপান্বিতা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে