সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভারত-পাকিস্তান তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে ইফতারে রয়েছে বৈচিত্র্য

যাযাদি ডেস্ক
  ২০ মার্চ ২০২৪, ০৯:৫৬
-ফাইল ছবি

রমজান মাস এলেই ইফতার ও সেহেরীর কথা সবার আগে আসে। এই মাসে অফিস, আদালত, দোকান, বাসা-বাড়ীতে এর জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করা হয়। সব মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয় এই ফিতার। ইফতারকে বিশ্বের ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দিতে তুরস্ক, ইরান, উজবেকিস্তান ও আজারবাইজান ইউনেস্কোর কাছে যৌথভাবে আবেদন করেছিল।

ইফতারের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর একে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।

সিয়াম সাধনার মাস রমজান। এ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মাসব্যাপী রোজা রাখেন। পূণ্য অর্জন ও আত্মশুদ্ধির আশায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা পানাহার থেকে বিরত থাকেন। মাগরিবের আজান শুনে মুখে খাবার তুলে রোজা ভাঙ্গেন। রোজা ভাঙ্গার এসময়কে বলা হয় ‘ইফতার’।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের ইফতার আয়োজনে রয়েছে বৈচিত্র্য। যদিও প্রায় সব দেশেই সাধারণত খেজুর বা পানির মতো হালকা কিছু দিয়ে ইফতার শুরু হতে দেখা যায়, কিন্তু দেশে দেশে ইফতার আয়োজনে বাহারি পদের খাবার দেখা যায়।

বাংলাদেশ

উপমহাদেশের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষকেও ইফতারে অনেক ভাজা-পোড়া খাবার খেতে দেখা যায়। এর মধ্যে থাকে- পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, বিভিন্ন ধরনের সবজির পাকোড়া ইত্যাদি। এ ছাড়া ইফতার আয়োজনে আরও থাকে মুড়ি, ছোলা বুট, জিলাপি, হালিমসহ নানা রকমের শরবত ও ফল।

এসব হালকা খাবারের পাশাপাশি অনেক পরিবার ইফতারের সময় হাতে তৈরি নানা রকমের পিঠা-পুলি, তেহারি, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, তন্দুরি চিকেনের মতো ভারী খাবারও খায়।

তবে ফলের মধ্যে খেজুর প্রায় অপরিহার্যই বলা যেতে পারে। এটি ছাড়া বাংলাদেশি মুসলিমদের ইফতার টেবিল একরকম অসম্পূর্ণই বলা যায়। মসজিদগুলোতে যে ইফতার আয়োজন করা হয়, সেখানেও খেজুরের উপস্থিতি থাকে। মূলত, মহানবী (সা.) ইফতারের শুরুতে খেজুর খেতেন বলে বিশ্বব্যাপী এটি এত জনপ্রিয়।

পাকিস্তান

পাকিস্তানে ইফতার আয়োজনে পানি এবং খেজুর তো থাকেই তবে সেখানে প্রাধান্য পেতে দেখা যায় মাংস ও রুটির মতো সেখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো। নানা ধরনের কাবাব, তান্দুরি, কাটলেট, টিক্কার উপস্থিতি প্রায় প্রতিদিনের ইফতারেই রেখে থাকেন বড় অংশের পাকিস্তানি।

এসব ভারী খাবারের পাশাপাশি ইফতারের সময় বিভিন্ন ভাজাপোড়া খাবারও খেয়ে থাকেন তারা। যেমন- রোল, নিমকি, মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি করা এক ধরনের বিশেষ সমুচা, বিভিন্ন ধরনের চপ, পাকোড়া ইত্যাদি।

এ ছাড়া নানারকম শরবত, ফল বা ফলের সালাদ, ছোলা-বুট, ফালুদা, জিলাপি, এমনকি বিরিয়ানি দিয়েও তাদের ইফতারের টেবিল সাজানো হয়। তবে পানীয় হিসেবে রুহ আফজার কদর এ দেশে সবচেয়ে বেশি।

ইন্দোনেশিয়া

দেশটির মানুষজন ইফতারে তেল ও মশলা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে বিভিন্ন রকম ফল এবং ফলের শরবতকে প্রাধান্য দেয়। এ ছাড়া তাদের ইফতার আয়োজনে নানা রকম মিষ্টি জাতীয় খাবারও থাকে।

ইন্দোনেশিয়ার সংবাদপত্র দ্য জাকার্তা পোস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুবুর চ্যান্ডিল নামক এক ধরনের মিষ্টান্ন; মিষ্টি আলু দিয়ে তৈরি বিজি সালাক; কলা, মিষ্টি আলু অথবা কুমড়া দিয়ে তৈরি কোলাক; কলা দিয়ে তৈরি এস পিসাং ইজোসহ আরও নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার এসময় ইন্দোনেশিয়ানরা তৈরি করে থাকে।

ভারত

দেশটির একেক রাজ্যের ইফতার আয়োজনে একেক খাবার জনপ্রিয়। যেমন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন বলছে, ভারতের হায়দ্রাবাদের মুসলিমরা ইফতারে হালিম খেতে পছন্দ করেন। আবার কেরালা ও তামিলনাড়ুর মুসলমানরা ইফতার করেন ‘নমবু কাঞ্জি’ নামে এক ধরনের খাবার দিয়ে।

নমবু কাঞ্জি হলো মাংস, সবজি এবং পরিজের সমন্বয়ে তৈরি এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। তবে সামগ্রিকভাবে দেখলে ভারতেও ইফতারে ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার খাওয়ার চল আছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অলিতে-গলিতে ইফতারের আগে আগে নানা ধরনের পাকোড়া, সমুচা, চপ ইত্যাদি বিক্রির ধুম পড়ে যায়।

তবে দিল্লিসহ দেশটির উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ইফতারের শুরুতে পানির সাথে থাকে খেজুর, ছোলা-বুট, হরেক রকম ফল ও ফলের শরবত, দুধ, ডিম, দইয়ের মতো খাবার।

ভারী খাবারের মাঝে থাকে বিভিন্ন ধরনের কাবাব, হালিম, কাটলেট, শর্মা, স্যুপ, বিরিয়ানি ইত্যাদি।

নাইজেরিয়া

নাইজেরিয়ার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ইফতারে শর্করা জাতীয় খাবার ও ফলমূলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেমন জল্লফ রাইস, এটি নাইজেরিয়ানদের অন্যতম প্রধান খাবার। চাল, পেঁয়াজ, টমেটো, মরিচ ইত্যাদির সমন্বয়ে এটি তৈরি করা হয়। এটি তারা সবজি বা মাংসের সাথে খান।

পাশাপাশি মই মই (পুডিং), ইয়াম (এক ধরনের আলু), আকারা (বিন কেক), মাসা (রাইস কেক), ইলুবো ও আমালার (ইয়াম দিয়ে তৈরি এক বিশেষ খাবার) মতো আরও নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারও তাদের ইফতার তালিকায় থাকে।

মিশর

রমজানে মিশরের মানুষের ইফতার টেবিলে থাকে নানা ধরনের খাবারের সমারোহ। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘আতায়েফ’ ও ‘কুনাফা’। আতায়েফ হলো এক ধরনের প্যানকেক ও কুনাফা এক ধরনের সিরাপ।

এ দুটো খাবার মিশরীয় মুসলমানদের ইফতারের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা যেতে পারে। তবে দেশটির অনেক পরিবার ইফতারে বাদামি রুটি এবং মটরশুঁটি, টমেটো, বাদাম ও অলিভ অয়েল দিয়ে তৈরি ‘ফুল মেদেমাস’ নামক এক ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করেন।

মিডল ইস্ট আই’র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিশরীয়রা তাদের ইফতারে এপ্রিকটস ফল দিয়ে তৈরি কামার-আল-দিনান্দ আরায়সি এবং দুধ, ভ্যানিলা ও নারিকেল দিয়ে তৈরি সোবিয়া নামক পানীয় পান করেন। এ ছাড়া তাদের খাবার টেবিলে বিভিন্ন ধরনের ফল, ফলের রস, সবজি ইত্যাদিও থাকে।

তুরস্ক

অন্য মুসলিম দেশগুলোর মতো ইফতারের তাদেরও পছন্দের শীর্ষে থাকে খেজুর। সেইসাথে বিভিন্ন ফলমূল, শরবত, হরেক রকম কাবাব তাদের খাদ্য তালিকায় থাকে। তবে রমজানে দেশটির মুসলমানদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার হলো রামাজান পিদেসি, যা মূলত এক ধরনের রুটি।

এটি নান রুটির মতো একই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। প্রথমে ময়দার সাথে দুধ, মাখন, জলপাই দিয়ে খামির তৈরি করা হয়। পরে রুটির ভেতর ডিম ও গরুর মাংসের পুর দিয়ে সেটিকে চুলায় বেক করা হয়।

ইরান

রুটি, স্যুপ, র‍্যাপ, কাবাবের মতো সুপরিচিত খাবারের পাশাপাশি ইফতারে ইরানের ঘরে ঘরে তৈরি হয় জাফরানের ঘ্রাণযুক্ত এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী পার্শিয়ান হালুয়া। এ ছাড়া জাফরান চাল দিয়ে তৈরি ‘শোলেহ জার্দ’ নামক এক ধরনের পুডিংও ইরানিদের খুব প্রিয়।

পার্শিয়ান নুডুলস, সবজি, পেঁয়াজ, বিন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি আশ রাসতেহ নামক ঘন স্যুপ ও হালিমও সেখানে ইফতারের সময় আগ্রহ নিয়ে খাওয়া হয়।

সেইসাথে তাদের ইফতারে আরও থাকে স্যান্ডউইচ, চা, তাবরেজি চিজ, জুলবিয়া (বাংলায় যাকে জিলাপি বলা হয়), বামিয়েহ নামক এক ধরনের মিষ্টান্ন ইত্যাদি।

উল্লেখ্য, ইরানের অন্যতম প্রধান খাবার হলো খেজুর। তাই, ইফতার টেবিলে এর উপস্থিতি অনেকটাই অপরিহার্য।

আলজেরিয়া

আলজেরিয়ান মুসলিমরা পিজ্জা ‘সোয়ারবা’, সবজি রোল, আলু, সবজি দিয়ে তৈরি দোলমা ইত্যাদি দিয়ে তাদের ইফতার শুরু করেন।

মাগরিবের নামাজের পর তারা ‘সিগার’ নামক এক ধরনের পানীয় পান করেন, যা বাদাম দিয়ে তৈরি। এ ছাড়া তাদের ইফতারের তালিকায় বিভিন্ন স্যুপও থাকে।

সৌদি আরব

আরব নিউজের এক প্রতিবেদন বলছে, সৌদিরা ইফতারের শুরুতে ‘গাহওয়া’ নামক অ্যারাবিক কফি পান করেন এবং সেইসাথে অবশ্যই খেজুর খান। এরপর তারা মাগরিবের নামাজ পড়েন।

নামাজ শেষে তারা ভারী খাবার খান। সৌদি আরবেও অঞ্চলভেদে ইফতারের খাবারে ভিন্নতা রয়েছে। দেশটির পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ তাদের ইফতারে শৌরাইক রুটি ও দুজ্ঞাহ নামক ঐতিহ্যবাহী খবার খান। আবার পূর্বাঞ্চলের লোকেরা ইফতারে সালুনা নামের একটি খাবার খান, যা মাংস ও সবজির স্টু দিয়ে তৈরি।

দেশটির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মানুষ তাদের রোজা ভাঙ্গেন আসিদাহ, মারগগ, মাফরৌক ও মাতাজিজ নামক ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে। এগুলো বাদামি আটা, গরুর মাংস, সবজি, মধু, পেঁয়াজ বা ঘি দিয়ে তৈরি করা হয়।

দেশটির আরেকটি জনপ্রিয় খাবার থারিদ, যা মূলত ভেড়ার মাংস ও সবজি দিয়ে তৈরি স্যুপ জাতীয় খাবার।

ইফতারকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি

বিশ্বজুড়েই ইফতারের আয়োজন মানেই মুসলিমদের কাছে যেন উৎসব। যারা রোজা পালন করেন না তাদের অনেককেও ইফতারের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

যেমন- শিশুদের জন্য রোজা রাখার বিধান না থাকলেও অনেক পরিবারেই দেখা যায় যে বড়দের পাশাপাশি তরুণরা, এমনকি শিশুরাও ইফতারের খাবার প্রস্তুত করতে এগিয়ে আসে। তবে পরিবারের সাথে ইফতার করার পাশাপাশি অনেক মুসলিম মসজিদে গিয়ে সবার সঙ্গে মিলেমিশে ইফতার করেন। এতে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মজবুত হয়। সূত্র : বিবিসি বাংলা

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে