পৃথিবীব্যাপী আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পিরামিডের ভিত্তিভূমিতে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে শিক্ষাকে একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করার কথা নির্ধারিত হয়েছিল (অণুচ্ছেদ ১৭) । আইনত দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্যে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন বাধ্যতামূলক; সরকার বিনামূল্যে এ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে (বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন ১৯৯০)।বহুল আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ সর্বজনীন ও সবার জন্য একই মানেরপ্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।শিক্ষার্থীকে জীবনযাপনের জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা, জীবন-দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, সামাজিক সচেতনতা অর্জন এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলাকে প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে স্থির করা।উপরন্তু বাংলাদেশ বর্তমানেজাতিসংঘ এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনে কাজ করছে যার ৪ নম্বর অভীষ্টে রয়েছে গুণগত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি, যে কোনো পরিবেশ খাপ খাওয়ানো কৌশল আয়ত্ত করা। একই অভীষ্টে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ এর কথা বলা হয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকার ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের মাধ্যমে যুগান্তকারী পদক্ষেপ রাখেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেন। এছাড়া দেশের বিদ্যালয়বিহীন এলাকার ১ হাজার ৫০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব্যবস্থা যেখানে ১৬ মিলিয়ন শিক্ষার্থী ও প্রায় ৪ লক্ষ শিক্ষক রয়েছেন। এ সকল সরকারি উদ্যোগের ইতিবাচক প্রভাব পরেছে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে। বার্ষিক প্রাথমিক শিক্ষা জরিপ ২০২১ অনুসারে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ৯৯% এবং ঝরে পড়ার হার ১৪.১৫ ( যা ২০১০ সালে ছিল ৩৯.৮%)। তবে গুণগত শিক্ষা প্রদানে বাংলাদেশের অর্জন কতটুকু সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ জরিপে এসেছে বাংলাদেশের ৫০% এর বেশি শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারেনা। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা তার চাইতেও বেশি। দেখা যায় ৩য় শ্রেণির ৬০% ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০% গণিতে কাঙ্ক্ষিত অর্জন করতে পারেনি। এসব অর্জনের আবার ভৌগলিক অঞ্চল ভেদে ভিন্নতা হয়েছে।
আছে স্কুলের ধরণভেদে ভিন্নতা। আবার একই বিদ্যালয়ে সকল শিক্ষার্থীর অর্জন সমান হয়। গুণগত মান বৈষম্যের কারণ মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায় এভাবেঃ শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম, শিশুবান্ধব অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষকদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্বের অভাব, আনন্দহীন শিক্ষার পরিবেশ, বিদ্যালয়ে পাঠাগার ও হাতে-কলমে শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য ও অভিভাবকদের আন্তরিকতার অভাব ইত্যাদি ।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা বহুধারায় বিভক্ত। একই কারিকুলাম ও একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা জাতীয় শিক্ষানীতিতে ব্যক্ত হলেও এ ব্যাপারে অগ্রগতি সামান্যই। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাইরে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৫৩০০০। এসবের মধ্যে রয়েছে বেসরকারি স্কুল তথা কিন্ডারগার্টেন, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, এনজিও পরিচালিত স্কুল ইত্যাদি। এদের বেশির ভাগের অবস্থান শহর ও শহরতলিতে।অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এসব বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনের উদ্যোক্তা। শহরের এমনকি গ্রামের স্বছল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এসব বেসরকারি স্কুলে পাঠিয়ে থাকেন। তবে নিম্নবিত্তের মানুষের সন্তানের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই একান্ত গন্তব্য।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মিত হলেও দেখা যায় স্কুলে যাতায়তের সড়কটির বেহাল দশা থাকাতে নতুন অবকাঠামোর পরিপূর্ন উপকারিতা পাওয়া যাচ্ছেনা। উপকূলীয় এলাকা ও চরাঞ্চলে এ সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির কারণে শিক্ষার্থিরা স্কুলে যেতে পারেনা। ফলে তাদের লার্নিং লস হয়। চর এবং দুর্গম এলাকায় শিক্ষক ধরে রাখা আরেকটি সাধারণ সমস্যা। নিয়মিত শিক্ষকের পরিবর্তে প্রক্সি শিক্ষক ব্যবহারের বিষয়টি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে শিক্ষক নিয়োগের সময় বিশেষ শর্ত ও নিয়োগের পরে ফলাফল ভিত্তিক বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্থানীয় বাস্তবতার আলোকে উত্তম চর্চা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত শিখন ফল অর্জনের চেষ্টা করা যেতে পারে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ, ক্রীড়া, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু দেখা যায় একটা বড় সংখ্যক বিদ্যালয়ের মাঠ নেই। অনেক বিদ্যালয়ের কাগজে কলমে মাঠ থাকলেও বাস্তবে তা বেদখল হয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে মাঠ পুরো বর্ষা মৌসুমে খেলার অযোগ্য হয়ে থাকে। পাঠদানকে আনন্দময় না করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত মান অধরা থেকে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাম্য অনুপাত এখনো অর্জন করা যায়নি। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ অনুপাত হওয়ার কথা ১:২০ যা বাংলাদেশে ১:৫৪। এ অনুপাত নিয়ে শ্রেণীকক্ষে তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীকে আলাদা যত্ন নেয়া কঠিন। নতুন করে নির্মিত ভবনসমূহের আকৃতি ও পরিমাপ একই রকমের (prototype)। এই ভবনগুলোতে গড়ে ০৫ টি শ্রেণি কক্ষ থাকে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা মাথায় রেখে ক্লাসরুমের আকার নির্ধারণ করা হয়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে ০২ শিফটে ক্লাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিক্ষকদের অধিক সংখ্যক ক্লাস নিতে হয় বিধায় তারা ক্লাসে কম মনোযোগ দিতে পারেন।
দারিদ্র্যতাকে শিক্ষণ ফল অর্জনে একটা বাঁধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আমিষ ও ক্যালরির চাহিদা পূরণ না হলে একজন শিশুর মানসিক ও শাররীক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় । অপুষ্টি ও ক্ষুধার কারণে শিক্ষার্থিরা ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারেনা। প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করতে পারেনা। বাংলাদেশে ২০২২ পর্যন্ত নির্বাচিত কিছু বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু ছিল যা স্কুলে উপস্থিতি ও ঝড়ে পড়া রোধে সহায়ক বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সরকার বর্তমানে সকল বিদ্যালয়ে মীড ডে মিল চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইন্টারনেট ও মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদানকে আনন্দময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়। সরকার সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ও প্রোজেক্টর বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় শিক্ষকদের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে ও মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে অনাগ্রহ বিদ্যমান। বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় বেশিরভাগ ডিজিটাল সরঞ্জাম অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। শিক্ষকদের সম্মান ও সুযোগের অভাবের কথা বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়। শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বাড়লে মেধাবীরা এ খাতে আসতে আগ্রহী হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব দৃশ্যমান। অনেকে প্রশিক্ষণ পেলেও তা বিষয়ভিত্তিক নয়। যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার এর মাধ্যমে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের বাইরে প্রাইভেট টিউটরিং কে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
বেশিরভাগ স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি থাকলে শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষণ অগ্রগতি মূল্যায়নে তাদের অংশগ্রহণ কম। এক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে। শিক্ষা কার্যক্রমে নতুনত্ব ও সৃজনশীলতা আনতে স্থানীয় এনজিও, মিডিয়া ও শিক্ষা গবেষকদের যুক্ত করা যেতে পারে। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষা উপকরণের বিষয়ে স্থানীয় অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একসময় এদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বিদ্যোৎসাহী মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত ও পরিচালিত হতো। উপরন্তু সরকারি বরাদ্দের বাইরে প্রয়োজন মেটাতে স্থানীয় সরকারগুলো (উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন) পরিষদ এগিয়ে আসতে পারে।
প্রান্তিক ও অসুবিধাগ্রস্ত পরিবারের শিশুদের প্রতি আলাদা মনোযোগের কোন বিকল্প নেই। স্থানীয় উদ্যোগে তাদের জন্য বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর স্বেছশ্রমের উপর ভিত্তি করে একটি রিসোর্স পুল গঠন করা যেতে পারে যারা পিছিয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে কাজ করবেন এবং শিক্ষণ ঘাটতি দূর করবেন। পাঠ্যক্রম বহির্ভূত সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য আলাদা দায়িত্বপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের পরিসর বাড়তে হবে। উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে হাইজিন, স্যানিটেশন সহ বিভিন্ন লাইফ স্কিল শেখানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে ।
উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। প্রাথমিক শিক্ষা একটি শিশুর জীবনে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও জ্ঞানার্জনের মূলভিত্তি তৈরি করে। সে কারণে, শারীরিক ও মানসিকভাবে সুসংগঠিত করে প্রগতিশীল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট সমাজ বিনির্মাণে সব শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, গলাচিপা, পটুয়াখালী।
যাযাদি/ এস