শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা 

কামরুল হাসান কামু
  ১৮ মার্চ ২০২৪, ১৩:২৬
-ফাইল ছবি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহুকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। পিতা শেখ লুৎফুর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বাঙালির ইতিহাসের এক মহানায়ক। নানা শেখ আবদুল মজিদ আদরের নাতির নাম শেখ মুজিবুর রহমান রাখলেও বাবা-মার কাছে ছিলেন ‘খোকা’।

গ্রামীণ জনপদের প্রাণ- প্রকৃতির সাথে হেসে খেলে বেড়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দুরন্ত শৈশবে কখনো নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি, কখনো ধুলোমাখা মেঠোপথের সাথে মিতালী, কখনো বর্ষার কাদাজলে বাধাহীন শৈশবের উচ্ছ্বাস যেন জুঁইফুলের মতো হেসেছে, কখনোবা পাখপাখালির সাথে খুনসুটি করে কেটেছে কিশোর মুজিবের শৈশব। নির্মোহ জীবনের পথে পথে নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে পৌঁছে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তাঁর শৈশবকাল বিশ্লেষণ করলে সহজে বুঝা যায় সে চিত্র।

তৎকালে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অভাব অনটনের জন্য জায়গির থেকে অনেকে পড়াশোনা করত। সকালে ভাত খেয়ে অনেকে চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসত আবার স্কুল শেষে সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দূরে হেঁটে বাড়ি ফিরত। মুজিব এইসব ছেলেদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন এবং সকলকে নিয়েই খাবার খেতেন। গরিব ঘরের ছেলেদের ছাতা কিনবার সামর্থ্য ছিলোনা, দূরের পথে রোদ বা বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে মুজিব নিজের ব্যবহৃত ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিতেন তাদের। স্কুল ছুটি হলে মা সায়েরা খাতুন বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতেন, খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তাঁর খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছেন। এমন উদার মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবের মননশীলতা আরো প্রস্ফুটিত করেছিলেন গৃহশিক্ষক আব্দুল হামিদ। সেসময় শিক্ষক আব্দুল হামিদ গরিব শিক্ষার্থীদের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য গঠন করেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি'। এই সমিতির সদস্যরা মুসলমান বাড়ি থেকে মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে তা বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচের জোগান দিত। এমনকি ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিত। শেখ মুজিব নিজেকে এই সমিতির কাজের সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন। শিক্ষাগুরু আব্দুল হামিদ হঠাৎ যক্ষা রোগে মারা গেলে শেখ মুজিব সমিতির দায়িত্বভার গ্রহণ করে তা পরিচালনা করেন। সংগঠন পরিচালনার এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে মুজিবের পথচলাকে সহজ করেছিলো।

বিপদাপন্ন মানুষের দুঃখে মুজিবের হৃদয় ভারাক্রান্ত হতো যার প্রমাণ পাওয়া যায় ছেলেবেলার আরেকটি ঘটনায়। একবার তাঁর গ্রামের কৃষকদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে অভাব। কোন কোন বাড়িতে দুবেলা ভাত রান্না বন্ধ হয়ে যায়। উৎকন্ঠা আর দুশ্চিন্তায় ছেয়ে যায় চাষীদের মুখাবয়ব। তাদের সন্তানরা অভুক্ত। সারা গ্রামেই প্রায়-দুর্ভিক্ষাবস্থার গুঞ্জন। কিশোর মুজিবের হৃদয় ছটফট করছিলো তাদের জন্য। তাই পিতাকে অনুরোধ করলেন তাদের গোলা থেকে বিপদগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে ধান বিতরণের অথচ নিজেদের ধানের মজুদ কেমন, এই অনুরোধ তার বাবা রাখতে পারবেন কিনা, সেসব তিনি ভাবেননি। মূলত কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার চিন্তাটিই ছিল তখন তার কাছে মুখ্য।

সে সময়ের শিক্ষিত পরিবার ঘরে পত্রিকা রাখত। শেখ মুজিবের বাবা বাড়িতে খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত এসবই সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা। এইসব পত্রিকার জ্ঞান শেখ মুজিবের জীবনকে ঋদ্ধ করেছিলো। কৈশোরে মুজিব ছিলেন খেলাপ্রিয়। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতেন। খেলার মাঝে যেমন আনন্দ খুঁজে পেতেন তেমনি নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি প্রস্ফুটিত হয়েছিলো।

তার পুরো রাজনৈতিক জীবনের বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিলো কিশোর বয়সে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। ১৯৩৮ সালে শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে আসেন। দলীয়ভাবে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় ছাত্রদের পক্ষ থেকে কথা বললেন শেখ মুজিব। এসময় স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার কথা জানিয়ে তা সংস্কার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও নিয়ে নিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে এসময় খানিক কথাবার্তা হয়। কথাবার্তার পর শেখ মুজিবের নাম-ঠিকানা লিখে নেন সোহরাওয়ার্দী। চলে পত্র যোগাযোগ। ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুরু- শিষ্যের পথচলা সুদৃঢ় হয়। বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব থেকে এ প্রজন্মের শিশু -কিশোরদের শেখার আছে অনেক। আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠুক মানবিকতা, শ্রদ্ধা ও ভালেবাসা নিয়ে।

লেখক-

কামরুল হাসান কামু

কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা

ফুলপুর, ময়মনসিংহ

ইমেইলঃ [email protected]

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে