আবু সাঈদসহ সারা বাংলাদেশে অসংখ্য ছাত্র শাহাদাতবরণ করার পর আন্দোলনকে কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা কোনোভাবেই যৌক্তিক ও নৈতিক ছিল না। আন্দোলনের পরবর্তী কৌশল কী হতে পারে, সেজন্য সাদিক কায়েমসহ আরও অনেকের সঙ্গে আমরা পরামর্শ করি। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা ৯টি কৌশলী দাবি প্রস্তুত করি। দাবির ভাষা এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যাতে দাবিগুলো সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই মানা সম্ভবপর না হয়; মানলেও সরকারের ফ্যাসিবাদী কাঠামো যেন ভেঙে যায়।
ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার আগেই আমাদের আশঙ্কা ছিল খুব শিগগিরই নেটওয়ার্ক শাটডাউন করে দেওয়া হবে। ইন্টারনেট শাটডাউনের আগেই আমরা আসিফ-নাহিদসহ কয়েকজনের কাছে এগুলো পাঠাই, যাতে তারা নিজেদের মধ্যে পর্যালোচনা-পরামর্শ করতে পারেন। এর আগের কর্মসূচির ক্ষেত্রেও নিয়মিত তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করা হতো, কিন্তু তাদের সঙ্গে অনলাইন-অফলাইন উভয় মাধ্যমে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকেই বাকি সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হয়।
দাবির খসড়া যখন প্রস্তুত করা হয় তখন সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়—‘শেখ হাসিনাকে বক্তব্য প্রত্যাহার ও ছাত্রহত্যার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে।’ পরে কয়েকজন সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় তত্বাবধায়কের সঙ্গে আলোচনা করলে তারা পরামর্শ দেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে এখনই সরকার পতনের ডাক দিলে তা প্ল্যাটফর্মটিকে বিতর্কিত করবে। এছাড়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রেরকসহ সব নেতার ওপর অসহনীয় চাপ, জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসতে পারে। সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপে এ বিষয়ে আলোচনা হয়।
আমরা কৌশলী ভূমিকা হিসেবে উল্লেখ করি, ‘ছাত্রহত্যার দায় নিয়ে শেখ হাসিনাকে জাতির সামনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।’ দাবিটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যেটি মেনে নিলে শেখ হাসিনার সরকারে থাকার নৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার বাতিল হয়ে যায়।
ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে আমরা দুটা বিকল্প রাখি—ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ অথবা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। পরিস্থিতি বিবেচনায় যেন যে কোনো একটি ঘোষণা দেয়া যায়।
আন্দোলনের সময়ে হলের যে শিক্ষার্থীরা দুঃসাহসী ভূমিকা রেখে সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগকে হল ও ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করেছিল, ওইসব শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ৯ দফায় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি যুক্ত করা হয়েছিল। তখনও আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক দফায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটনের আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এই দফার সংযুক্তি সময় বিবেচনায় অত্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল। বর্তমানে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটনের মাধ্যমে সেই সংকটের সমাধান হয়েছে; একই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির পুরো সিস্টেমে প্যারাডাইম শিফটিংয়ের সুযোগও তৈরি হয়েছে।
ফিরে আসি মূল কথায়। ১৯ জুলাই ৯ দফা প্রস্তুত শেষে আব্দুল কাদেরকে ফোন করে জানালে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সম্মতি দেন। তবে কয়েকটা দাবির ক্ষেত্রে আব্দুল কাদেরের নিজস্ব অভিমত থাকে, যা আমরা আবারও আলোচনা করে চূড়ান্ত করি। আব্দুল কাদেরকে নতুন একটা নম্বর নিতে বলা হয়, যেখানে সাংবাদিকেরা ফোন করে নিশ্চিত হবেন ৯ দফা সম্পর্কে। সে অনুযায়ী সাংবাদিকরা নিশ্চিত হন।
আন্দোলনের প্রথম দিন তথা ৫ জুন প্রথম কর্মসূচির আগেই সাদিক কায়েম ও আমার সঙ্গে নাহিদ ইসলাম ও মাহফুজ আলমের ফোনে কথা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় তারা নিয়মিতই বিভিন্ন পরিকল্পনা শেয়ার করেন ও আমরাও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার কথা জানাই। আন্দোলনের শুরু থেকে আমাদের পরিকল্পনা ছিল সংঘর্ষ এড়িয়ে ধীরে ধীরে কঠোর কর্মসূচির দিকে যাওয়া। কর্মসূচির ধরন ও বাস্তবায়নের প্রতিটি বিষয়ে সমন্বয় করা হতো মাহফুজ আলমের সঙ্গে। শুরুর দিকে কর্মসূচিগুলোয় আকতার হোসেন ও মাহফুজ আলমের সঙ্গে প্রায়ই পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতা অব্যাহত ছিল। দেশব্যাপী কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিবিরের কেন্দ্রীয় ও সারাদেশের শাখাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলনে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হয়।
নিয়মিত কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ১৩ জুলাই আমরা মাহফুজ আলমকে পরদিনের কর্মসূচি হিসেবে ‘রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান’-এর পরামর্শ দেই। পরিকল্পনা ছিল ছোট ছোট কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ‘রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান’ হবে আমাদের সর্বশেষ সফট কর্মসূচি, এর পর থেকে কঠোর কর্মসূচিতে যাব।
মাহফুজ আলম অন্যদের সঙ্গে এই পরিকল্পনা নিয়ে মতবিনিময় করেন, এতে তারা রাজিও হন এবং ১৩ জুলাই রাতে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। রাতের মধ্যেই আমাদের সাংগঠনিক টিমের সহযোগিতায় পুরো স্মারকলিপির খসড়া করা হয়। খসড়ার কিছু সংশোধন নিশ্চিত শেষে চূড়ান্ত ডকস ফাইলটি রাতের মধ্যেই ড্রাইভ লিংক দিয়ে মাহফুজ আলমসহ ৬৪ জেলার আন্দোলনকারীদের কাছে পৌঁছানো হয়।
পরদিন ৬৪ জেলার ডিসিসহ রাষ্ট্রপতি বরারর আমাদের প্রস্তুত করা স্মারকলিপিটি প্রদান করা হয়। সেদিন বিকালে আন্দোলনকারীদের শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ সম্বোধন করায় সমালোচনা ও প্রতিবাদ শুরু হয়। সন্ধ্যা ৭ টায় নাহিদ ইসলাম ফোন করে বললেন, ‘কী করা যায়?’ জবাবে বললাম, ‘রাত ১১টায় রাজুতে প্রতিবাদ মিছিলের ঘোষণা দেন, তবে অন্য কোনো মুখপাত্রের মাধ্যমে দেবেন, যাতে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি হল থেকেই প্রতিবাদী মিছিল বের হয়। হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
১৫ জুলাই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী আক্রমণের পর থেকে শিক্ষার্থীরা কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীদের মনোবল ফেরাতে পরদিন সাংগঠনিক পরিকল্পনা অনুযায়ী মহানগর শাখার জনশক্তিরা ক্যাম্পাসের চারপাশে বিশেষ করে চানখারপুল ও শহীদ মিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
ঢাকা কলেজ শাখা সাহসী ভূমিকা রাখেন সায়েন্সল্যাবে। এভাবে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আক্রমণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা সফল হয়।
ক্যাম্পাসের চারপাশে বিশেষ করে চানখারপুল, শহীদ মিনারসহ ঢাকা কলেজ শাখা সাহসী ভূমিকা রাখে সায়েন্সল্যাবে। এভাবে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আক্রমণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা সফল হয়।
১৬ জুলাই দিবাগত রাতে চলে সশস্ত্র ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অভিযান। এর ফলে ১৭ জুলাই সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস পান ছাত্ররা।
১৬ জুলাই সন্ধ্যায় মাহফুজ আলম ও নাহিদ ইসলামকে আমরা ফোন করে পরদিনের কর্মসূচি হিসেবে ‘কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা’ ঘোষণা দেওয়ার পরামর্শ দিই। তাদের দিক থেকে বাকি সমন্বয়কদের রাজি করে সেই কর্মসূচির ঘোষণা আসতে প্রায় রাত ১২টা বেজে যায়। কর্মসূচি বাস্তবায়নে সাত শহীদের প্রতীকায়ন হিসেবে ৭টা কফিনের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা শাহবাগ থানা জামায়াতের সহযোগিতা নিই।
নানা নাটকীয়তা ও বিচক্ষণতায় আমাদের ছাত্র আন্দোলন বিভাগ ক্যাম্পাসে কফিনগুলো নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মিছিলের শুরু হতেই চলে পুলিশের আক্রমণ। দিন-রাত পেরিয়ে চলছে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি। একদিকে ৯ দফায় আওয়াজ, মিডিয়াতে চলে এক অদৃশ্য যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন ‘ক্রেডিটবাজির’ ঊর্ধ্বে থাকা দেশপ্রেমিক সাংবাদিক যোদ্ধাদের একটি টিম।
গণহত্যা ও গণগ্রেপ্তারের একপর্যায়ে দুর্বল হয়ে যাওয়া আন্দোলনকে নতুন উদ্দামে চাঙ্গা করতে সাংগঠনিকভাবে আমরা সফট কর্মসূচিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হিসেবে আন্দোলন পায় নান্দনিক মাত্রা, সব শ্রেণিপেশার মানুষ যুক্ত হয়। সফট কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেয়াললিখন, গ্রাফিতি ও অনলাইন ক্যাম্পেইনের মতো কর্মসূচি।
রাষ্ট্রীয় শোকের নির্মম নাটককে প্রত্যাখ্যান করে মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ এবং অনলাইন ক্যাম্পেইনের পরামর্শ দিয়েছিলাম সাদিক কায়েমকে। ২৯ জুলাই রাতে তিনি সেটি চূড়ান্ত করে প্রেস রিলিজ আকারে সমন্বয়কদের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। এই কর্মসূচিতে অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হয়ে মাঠের কর্মসূচির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
বহুল আলোচিত ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ ও ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ প্রোগ্রামের নাম নির্ধারণে সহযোগিতা করেন সাংবাদিক তাওসিফ। নামগুলো চূড়ান্ত করে যথারীতি প্রেস রিলিজ আকারে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ধীরে ধীরে মার্চ ফর জাস্টিস, কিংবা গণমিছিল পেরিয়ে প্রতিবাদের মাত্রা চলে যায় অসহযোগ আন্দোলনে। সেই আহ্বানে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
অন্যদিকে পুলিশ ও ছাত্রলীগের গণহত্যার ভয়ংকর ও বীভৎস দৃশ্য দেখা যায় গোটা বাংলাদেশে! ক্ষণে ক্ষণে পাড়ি দেওয়া উত্তাল এই যাত্রার সর্বশেষ ধাপ—চিরচেনা সেই শহীদ মিনার থেকে এক দফার ঘোষণা। এক দফা ঘোষণা শেষে গণভবনমুখী যাত্রার তারিখ ও সুনির্দিষ্ট স্পট নির্ধারণ এবং সরকারকে স্পটের ব্যাপারে কনফিউজড রেখে গণভবন বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ছাত্রশিবির ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী শক্তি।
আমাদের সৌভাগ্য, আমরা জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের অংশ হতে পেরেছিলাম এবং আমাদের প্রস্তুত করা ৯ দফা সাদরে গ্রহণ করে জনগণ নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে সেসময় দাঁড়িয়ে যায় বুলেটের সামনে। এর ফলে স্বপ্নের এক দফা সফলতায় রূপ পেয়েছে।
৯ দফা কৃতিত্ব একক কোনো ব্যক্তি বা প্ল্যাটফর্মের নয়। এর কৃতিত্ব সেই শিশুটির, যে বারান্দায় খেলতে গিয়ে শহীদ হয়েছে, যারা অকুতোভয় সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে লড়াই করে গেছে ময়দানে। যাদের জন্য ‘৯ দফা’ হয়েছে ‘ফ্যাসিমুক্তির ৯ দফা’; রূপান্তরিত হয়েছে কাঙ্ক্ষিত ‘এক দফা’। বাংলাদেশে আর কোনো ফ্যাসিবাদ না আসুক, খালি না হোক আর কোনো মায়ের বুক।
লেখক : সভাপতি, ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যাযাদি/ এস