মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

‘ঘুম ভেঙ্গেই দেখি ওরা আমার বেডরুমে’

যাযাদি ডেস্ক
  ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৪৫
আপডেট  : ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩১
বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নুরুল হক নূরের স্ত্রী মারিয়া আক্তার -বিবিসি বাংলা

মিরপুরে একটি রেস্টুরেন্টের শ্রমিক শাওন হাওলাদার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান অভিযানে তিনি আটক হন নিজ বাসার সামনে থেকে। আটকের পর সিএমএম আদালতে হাজির করা হয় তাকে।

পুলিশ সদস্যরা যখন হাতকড়া পরানো অবস্থায় শাওন হাওলাদারকে আদালত ভবনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিন বছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছিলেন তার স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন। স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তান-তিনজনই কাঁদছিলেন উচ্চস্বরে।

“মিরপুরে যখন মারামারি হইছিলো, আমার স্বামী মোবাইলে ভিডিও করছে। এর দুই দিন পর বাড়ির সামনে ওরে দেইখ্যা পুলিশ ডাক দিছে। মোবাইল সার্চ কইরা যখন ভিডিওগুলো দেখছে, ওরে ধইরা নিছে।”

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবিসিকে বলছিলেন সুমাইয়া খাতুন। তার দাবি, তার স্বামী কোনো ‘গণ্ডগোলে’ ছিলেন না।

“তার একটা পা ভাঙ্গা। ঠিকমতো হাটতে পারে না। সে ক্যামনে মারামারি করবে? তারে ক্যান পুলিশ আটকাইলো?” প্রশ্ন সুমাইয়ার।

বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ধরপাকড় শুরু করেছে, সেখানে দশ হাজারেরও বেশি মানুষ আটক হয়েছেন বলে খবর দিচ্ছে গণমাধ্যমগুলো।

অভিযোগ উঠছে, মধ্যরাতের এসব ব্লক রেইডে 'নির্বিচারে' আটকের শিকার হচ্ছেন অনেকে। এছাড়া আটকের পর নিখোঁজ থাকা এমনকি রিমাণ্ডে নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

‘গুলি, লুটপাট, ভাঙচুরের’ অভিযোগ

সাভারে স্থানীয় বিএনপির সাবেক এক নেতা খোরশেদ আলম। গত ২০শে জুলাই বিকেলে খোরশেদ আলমের খোঁজে তার শ্বশুরের বাসায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সেদিন বাসায় খোরশেদে ছিলেন না। তার পরিবার জানাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাসায় ঢুকেই কয়েক রাউন্ড গুলি করে। এরপর ভাঙচুর করতে থাকে গ্যারেজে রাখা গাড়ি। বাদ যায়নি ঘরের আসবাবপত্র, টিভি, ফ্রিজ, এসি কোনকিছুই।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির একপাশে স্তূপ করে রাখা আছে ভাঙচুর হয়ে যাওয়া সকল জিনিসপত্র। দেয়ালে গুলির চিহ্ন।

“প্রায় ২৬ গাড়ি পুলিশ আসে বাড়ির সামনে। কেউ ছিলো পোশাকে, কেউ ছিলো টি-শার্ট পরা এবং হাতে লাঠি নিয়ে। এছাড়া বহিরাগতও ছিলো। আমার ড্রয়িং রুম ছিলো লোকে ভরা।” এভাবেই সেদিনের পরিস্থিতি বলছিলেন, খোরশেদ আলমের স্ত্রী কাওসার হাবিবা।

তিনি জানান, সেদিন বাসায় কোনো পুরুষ মানুষ ছিলেন না। একপর্যায়ে অভিযানে আসা পুলিশ সদস্যরা তাকে এবং তার মা’কে ঘুরে ঢুকতে বলেন।

“আমরা দু’জন ঘরে ঢুকতেছি, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন টান দিয়ে আমার গলা থেকে স্বর্ণের চেইনটা ছিঁড়ে নিলো। আমি ভয়ে কিছু না বলেই ঘরে ঢুকে পড়ছি। ওদের ভাঙচুর শেষে চলে যাওয়ার পর পাশের ঘরে দেখি ড্রয়ারে রাখা সাড়ে তিন লাখ টাকা নাই। সেদিনই আমি একটা পুরনো গাড়ি বিক্রি করে টাকাটা রাখছিলাম।”

কাওসার হাবিবা জানাচ্ছেন, সেদিনের অভিযানের পর থেকেই তার ভাইয়ের সাত বছর বয়সী ছেলে অস্বাভাবিক আচরণ করছে।

তিনি বলেন, “বাচ্চাটা দেয়ালে একটা বলের শব্দ হলেও ভয় পায়। হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলে পর্দার আড়ালে লুকায়। সেদিন পুলিশ যখন ঢুকছিলো, তখন সে আমাকে বলছিলো যে, আমাদেরকে কি এখন গুলি করবে? আমরা কি মারা যাবো?”

কাওসার হাবিবা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান করবে। কিন্তু ভাঙচুর, গুলি, লুটপাট কেন করছে সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না। তাদের সঙ্গে ‘হিংস্র আচরণ’ কেন করা হলো তারও কোনো জবাব নেই তার কাছে।

‘ঘুম ভেঙ্গেই দেখি ওরা আমার বেডরুমে’

সাভারে কাওসার হাবিবার বাসায় অভিযান হয়েছে দিনের বেলা। কিন্তু সম্প্রতি গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতা নুরুল হক নূরের বাড়িতে অভিযান হয়েছে মধ্যরাতে।

তার স্ত্রী মারিয়া আক্তার জানাচ্ছেন, ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙ্গার বিকট শব্দে ঘুম ভাঙার পর তিনি দেখতে পান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন তার বেডরুমের ভেতরে।

“আমি বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে বিছানা থেকে শুধু উঠে দাঁড়িয়েছি। এরমধ্যেই দেখি আমার রুমের ভেতরে ওরা। তাদেরই কেউ লাইট জ্বালানোর পর দেখি অস্ত্র হাতে ঘরভর্তি মানুষ। আমাদের তো একটা প্রাইভেসি আছে। আমরা সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রী ঘুমিয়ে আছি। সেখানে তারা এভাবে কেন ঢুকে পড়বে?” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মারিয়া আক্তার।

“আর তারা লাইট জ্বালানোর পর নুরকে দেখেই অকথ্য ভাষায় গালি দিতে শুরু করে। তারপর প্রায় থাবা দিয়ে মিনিটের মধ্যেই টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে যায়। কেন নিচ্ছে, তারা কারা কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিলো না।”

মারিয়া আক্তার বলছেন, তার ভাষায়, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই আটকের পর চল্লিশ ঘণ্টা নুরুল হকের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর যখন গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়, সেখানেও করা হয়েছে নির্যাতন।

“রিমান্ড শেষে যেদিন আদালতে হাজির করা হয়, সে হাঁটতে পারছিলো না। নুর আমাকে নিজেই বলেছে, রিমান্ডে ওকে ছাদের সঙ্গে উল্টো করে পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো। ওকে লাথি মেরেছে ফুটবলের মতো, পিটিয়েছে ইচ্ছেমতো।”

“ওকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছে যে, আমি একজন নারী হিসেবে আপনার সামনে সেটা উচ্চারণ করতে পারছি না। ওকে ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হয়েছে। ওকে এমন এমন জায়গায় আঘাত করা হয়েছে, যেটা আমি এখন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এই নির্যাতনের কারণে ও হাঁটতে পারছে না,” বলছিলেন মারিয়া আক্তার।

পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগের? বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয় মূলত ১৯শে জুলাই থেকে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত ঢাকার নির্দিষ্ট এলাকা ঘিরে মধ্যরাতে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে চলে গ্রেফতার অভিযান। এসব অভিযানে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তো বটেই, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, দিনমজুরসহ আটক হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

গত দুই সপ্তাহের অভিযানে দেশটির গণমাধ্যমগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দশ হাজারেরও বেশি আটকের তথ্য দিচ্ছে। এসব অভিযানে শুধু সাধারণ মানুষের হয়রানি নয়, বরং একইসঙ্গে মানবাধিকার লঙ্গনেরও অভিযোগ উঠছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, আটকের পর স্বীকার না করা, আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির না করা, গ্রেফতার অভিযানের সময় ভয়-ভীতি দেখানো, মারধর এমনকি গুলি করা এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন যার মধ্যে অন্যতম।

সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরমভাবে আইনের অবমাননা করছে।

“বৃটিশ আমলেও পুলিশ কারো বাড়িতে মধ্যরাতে অভিযান করতো না। বাড়ি ঘেরাও দিয়ে রেখে সকালে ঢুকতো। কিন্তু এখন মধ্যরাতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তারা গেটে ঠক্ ঠক্ করছে। এটা কি একাত্তর সাল? একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনী ঘরে ঘরে গিয়ে বলতো মুক্তি আছে? এখন এরা জিজ্ঞাসাবাদ করছে, ছাত্র আছে?”

মি. খান বলছেন, তার ভাষায়, পুলিশ গ্রেফতারের সময় আইন মানছে না।

“আইনে কোথাও নাই যে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে। এমনকি ৫৪ ধারায় কাউকে অ্যারেস্ট করলেও এ বিষয়ে আপিল বিভাগের নির্দেশনা আছে। তিন ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে কী মামলায় এবং কেন তাকে গ্রেফতার করা হলো।

"এছাড়া তার নিকটআত্মীয় স্বজন, আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা তারা মানতে বাধ্য। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা লংঘন করছে। এছাড়া কোর্টে যাদের পাঠাচ্ছে, সেখানেও নাবালক দেখা যাচ্ছে। নাবালককে তো কোনো অবস্থাতেই জেলখানায় পাঠাতে পারে না।”

তবে শুধু আটকের সময় আইনের লঙ্ঘন নয়, আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগও এখন জোরালো।

যদিও হেফাজতে থাকাকালীন আটককৃত ব্যক্তির সঙ্গে আচরণ কী হবে সেটার বিস্তারিত বলা আছে নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে। যেখানে সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, শাস্তি দেয়া এমনকি ভয়-ভীতি দেখানোও অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

“সংবিধানেইতো আছে কোন অবস্থাতেই গায়ে হাত দিতে পারবে না, জোর-জবরদস্তি করতে পারবে না। এছাড়া ডিবি অফিসে যে নিয়ে রাখা হচ্ছে, সেটারই বা আইন কোথায়? সেখানে কি থানা আছে, হাজতখানা আছে? আর সাদা পোশাকে যদি তুলে নেয়, তাহলে অবশ্যই সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়। ধরলাম, এটা যদি ডাকাতও তুলে নেয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটা ধরবে না?” প্রশ্ন রাখেন জেড আই খান পান্না।

কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ কেন উঠছে? জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অবশ্য পাল্টা দাবি করা হয়, অভিযানে আইনের কোনো লঙ্ঘন হচ্ছে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বিবিসি বাংলাকে বলেন, তার ভাষায়, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হচ্ছে।

“অ্যারেস্ট বা মামলা যেগুলো হচ্ছে, সেগুলো কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই হচ্ছে। এছাড়া আমরা যখন অভিযান করি তখন আমাদেরকে একটা প্রসিডিউর মেনেই করতে হয়, আইনের নিরিখেই করতে হয়। আপনি যেসব অভিযোগ করছেন, সেরকম কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। আইনি প্রক্রিয়া মেইনটেইন করেই আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করছি,” বলছিলেন মি. হক। বিবিসি বাংলা

যাযাদি/এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে