মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

বিশ্ব তাকিয়ে তাইওয়ানের দিকে

২০২২ সালের মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, আমেরিকা কি তাইওয়ানকে সামরিকভাবে রক্ষা করবে, তিনি এর উত্তর দেন 'হঁ্যা'। পরে অবশ্য হোয়াইট হাউস পরিষ্কার করেছে, ওয়াশিংটন তাদের 'এক চীন নীতি' থেকে সরে আসেনি। তবে চীনও আমেরিকার পর সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে এবং নৌবাহিনী থেকে ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান বা সাইবার হামলা সবকিছুতেই সামর্থ্যের প্রমাণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে...
যাযাদি ডেস্ক
  ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
তাইওয়ানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দেখা যায় ২০২৩ সালে

তাইওয়ানের ভোটাররা তাদের জন্য নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে আগামী ১৩ জানুয়ারি ভোট দিতে যাচ্ছেন। যে ভোটের দিকে বেশ গভীরভাবে তাকিয়ে আমেরিকা ও চীন। কারণ এই স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপটি ওয়াশিংটন এবং বেইজিং দুই পক্ষের জন্যই কৌশলগতভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই ভোটের ফল চীনের সঙ্গে দ্বীপরাষ্ট্রটির সম্পর্কে বড় প্রভাব ফেলতে পারে এবং একইসঙ্গে এই পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়াতে পারে ও সারা বিশ্বের অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করতে পারে।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) সাই ইং-ওয়েন। চীন এই রাজনৈতিক দলকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখে থাকে। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর সংবিধান অনুসারে সরে দাঁড়াচ্ছেন সাই ইং-ওয়েন। এখন তার উত্তরসূরি হওয়ার লড়াইয়ে তিনজন প্রার্থী আছেন। তবে ডিপিপি অন্যদের সঙ্গে জোট বেঁধে ১১৩ সদস্যের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখার আশা করছে, তাহলে আইন তৈরি, বাজেট, যুদ্ধ ঘোষণা এবং কূটনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকবে।

লাই চিং-তে, ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ

পার্টি (ডিপিপি)

লাই একজন সাবেক ডাক্তার, যিনি তাইওয়ানের সম্ভাব্য সবরকম শীর্ষ রাজনৈতিক পদেই বসেছেন। ২০২০ সাল থেকেই তিনি ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে। প্যান-গ্রিন জোটেরও নেতা তিনি এবং চীনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সম্পূর্ণ বিপক্ষে, তাইওয়ানের স্বতন্ত্র সত্তার পক্ষের একজন ঘোর সমর্থক। তিনি চীনের চেয়ে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। চীনের কাছে তিনি কট্টরপন্থী 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' এবং 'সাইয়ের চেয়েও আরও বেশি খারাপ'। কিন্তু ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, তিনি ততই সাইয়ের বলা কথারই পুনরাবৃত্তি করছেন। তাইওয়ান এরই মধ্যে স্বাধীন, আর এর নতুন করে কোনো ঘোষণার দরকার নেই।

হউ ইয়ো-ই, কুমিনতাং (কেএমটি)

হউ একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। ২০২২ সালে নিউ তাইপে সিটির (রাজধানীর পাশের শহর) মেয়র হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হন তিনি, একজন মধ্যপন্থার যোগ্য লোক হিসেবে খ্যাতি আছে তার। প্যান-বস্নু জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি, চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন, এমনকি প্রয়োজনে ভবিষ্যতে মিলিত হয়ে যাওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী তিনি। সম্প্রতি তিনি মন্তব্য করেন, তার আপাতত লক্ষ্য থাকবে, তাইওয়ানের বর্তমান যে পরিচিতি, অর্থাৎ চীনের সঙ্গে মিলে যাওয়াও না, আবার স্বাধীনতার ঘোষণাও না, সেটাই ধরে রাখা।

কো ওয়েন-জে, তাইওয়ান পিপলস পার্টি (টিপিপি)

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ২০১৪ সালে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের মেয়র পদে লড়ার আগ পর্যন্ত কো ছিলেন একজন সার্জন। ২০১৯ সালে তিনি তাইওয়ান পিপলস পার্টি গঠন করেন, যেসব ভোটাররা ডিপিপি ও কেএমটির প্রতি সন্তুষ্ট নয়, তাদের কাছে একটা তৃতীয় পছন্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এই দলটাকে। তবে তাইওয়ান ও চীনের ব্যাপারে টিপিপি'র অবস্থান ধোঁয়াশাপূর্ণ। কেএমটি ও টিপিপির যৌথভাবে নির্বাচনে লড়ার আলোচনা গত নভেম্বরে মুখ থুবড়ে পড়ে।

এই মুহূর্তে ভোটের আগের জরিপে ডিপিপি প্রার্থী লাই চিং-তে কেএমটি হউ ইয়ো-ই'র চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন, আর তার ঠিক পরের অবস্থানে তাইওয়ান পিপলস পার্টির কো ওয়েন-জে।

তাইওয়ানের জনগণ কী চায়?

চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের চলমান উত্তেজনার মধ্যেও, নানা গবেষণা বলছে, তাইওয়ানের জনগণ মনে করে অর্থনৈতিক উন্নয়নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসু্য। ২০২৩ সালে 'ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কাউন্সিল'র কর্মকর্তাদের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় ৩৪.২ শতাংশ লোক চায়, তাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিক।

চীন-তাইওয়ান সম্পর্ক এর চেয়ে অনেক পিছিয়ে ১৮.১ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে।

স্বল্প বেতন, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠী ও শ্রমিকদের মধ্যে সবকিছুর উচ্চমূল্য ও বাড়ির দাম দিনদিন বেড়ে যাওয়া নিয়ে ব্যাপক হতাশা বিরাজ করছে। সাই ইং-ওয়েন তার ২০১৫ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন, 'তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি ভালো দেশ গড়ার', কিন্তু অনেক ভোটারই মনে করেন, তিনি সেই প্রতিশ্রম্নতি পূরণ করেননি।

২০২২ সালের স্থানীয় নির্বাচনে ডিপিপি খুবই খারাপ ফল করে, যাতে পার্টির প্রধান থেকে সরে যেতে হয় সাইকে। এরজন্য অনেকেই দায়ী করে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ডিপিপির ব্যর্থতায়।

তাইওয়ানে যাদের বয়স ২০ বছর অথবা যারা এই দ্বীপে টানা ছয় মাস বসবাস করছেন, তারা ভোট দেওয়ার যোগ্য হবেন। অর্থাৎ, সম্ভাব্য ভোটার প্রায় ১৯ মিলিয়ন (১ কোটি ৯০ লাখ)। গত নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি হার ছিল ৭৫ শতাংশ।

চীন ও আমেরিকা কাকে নতুন প্রেসিডেন্ট চায়?

তাইওয়ান দ্বীপটি দক্ষিণ-পূর্ব চীনের উপকূল থেকে ১৬১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯৪৯ সালে কুমিনতাং সরকার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গৃহযুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর এটি মেইনল্যান্ড (মূল ভূখন্ড) থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয় এবং তখন থেকে স্বায়ত্তশাসিত হয়ে আসছে। কয়েক দশক পর তাইওয়ান নিজেদের সংবিধান অনুসারে কর্তৃত্ববাদ থেকে গণতন্ত্রে রুপান্তরিত হয়। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাইওয়ানে নিয়ন্ত্রণ রাখাকে মনে করে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একাধিকবার বলেছেন, 'একেন্দ্রীকরণ' অবশ্যই করতে হবে এবং প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। কিন্তু আমেরিকা এ রকম যে কোনো কিছুর পথে বাধা হতে ধীরে ধীরে নিজেদের তৈরি করেছে।

তাইওয়ানের অবস্থান তথাকথিত 'ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন'- যারা আমেরিকার মিত্র, যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিলিপাইন তাদের কাছেই, যারা আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি চীন কখনো তাইওয়ান দখল করে, তাহলে কোনো কোনো পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমের প্যাসিফিক অঞ্চলে তারা অবাধে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারবে এবং গুয়াম ও হাওয়াইয়ে থাকা আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিকেও হুমকির মধ্যে ফেলতে পারবে। তবে চীন জোর দিয়ে বলেছে, তারা শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বন করতে চায়।

চীন প্রতিমুহূর্তে চাপ বাড়িয়ে চলেছে, গত বছর বেশ কয়েকবারই তাইওয়ান অভিমুখে যুদ্ধজাহাজ ও বিমান পাঠিয়েছে তারা এবং দুই দেশের মধ্যকার যে প্রণালি যেটা সীমান্ত তৈরি করেছে, সেটাও বেশ কবার অতিক্রম করে তারা।

তাইওয়ান কি আত্মরক্ষায় সক্ষম?

চীনের সামরিক শক্তির মূল ফোকাস যদিও অন্যদিকে, কিন্তু যদি সব মিলিয়ে সক্রিয় সেনা সদস্যের সংখ্যা ধরা হয়, তাহলে দুই দেশের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য পাওয়া যায়। যে কোনো সামরিক মোকাবিলায় চীনের সামরিক বাহিনীর সামনে তাইওয়ান খুবই ক্ষুদ্র মনে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাইওয়ানের যথেষ্ট অস্ত্র নেই বা তারা সম্পূর্ণ একা। আমেরিকা ১৯৭৯ সালে তাইওয়ান থেকে চীনকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিলেও, তারা 'তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্টের' আওতায় নিয়মিত এই দ্বীপরাষ্ট্রের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে এসেছে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে আমেরিকা তাইওয়ানের কাছে প্রায় ৩৪৫ মিলিয়ন (৩৪ কোটি ৫০ লাখ) ইউএস ডলার মূল্যের অস্ত্র সহায়তার বিবরণ প্রকাশ করে। আর বছর শেষ হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও ৩০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের যন্ত্রপাতি বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে, যাতে তাইওয়ান তাদের কৌশলগত তথ্য ব্যবস্থাপনা চালু রাখতে পারে।

২০২২ সালের মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, আমেরিকা কি তাইওয়ানকে সামরিকভাবে রক্ষা করবে, তিনি এর উত্তর দেন 'হঁ্যা'। পরে অবশ্য হোয়াইট হাউস পরিষ্কার করেছে, ওয়াশিংটন তাদের 'এক চীন নীতি' থেকে সরে আসেনি। তবে চীনও আমেরিকার পর সামরিকখাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে এবং নৌবাহিনী থেকে ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান বা সাইবার হামলা সবকিছুতেই সামর্থ্যের প্রমাণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

তাইওয়ান গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন?

জাতিসংঘ তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না এবং সারা বিশ্বের মাত্র ১২টি দেশ এই স্বীকৃতি দিয়েছে (প্রধানত দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় ও ওশেনিয়া অঞ্চলের দেশ)। বিশ্বের বেশির ভাগ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যা আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি, ফোন থেকে ল্যাপটপ, ঘড়ি, গেম কনসোল- এ সবই তাইওয়ানের তৈরি কম্পিউটার চিপসের সাহায্যে চলে।

এদিক থেকে তাইওয়ানের শুধু একটা কোম্পানি 'দ্য তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফাকচারিং কোম্পানি' বা টিএসএমসি- সারা বিশ্বের অর্ধেক বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। টিএসএমসিকে তাই বলা হয় 'ফাউনিন্ড্র', এমন একটা কোম্পানি, যারা চিপস ভোক্তা ও সামরিক ক্রেতাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা বিরাট বড় শিল্প, ২০২১ সালের হিসেবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) ইউএস ডলার।

বিগত বছরগুলোতে ওয়াশিংটন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য নানা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে প্রযুক্তিক্ষেত্রে চীনের প্রবেশাধিকার কমে আসে এবং আমেরিকা ও তাইওয়ানসহ তাদের মিত্ররা মাইক্রোচিপ তৈরিতে আরও এগিয়ে যেতে পারে। তাইওয়ানে চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বেইজিংকে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এনে দিতে পারে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে