মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ

নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে জেরবার তৃণমূল

২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ প্রায় নিরঙ্কুশ হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। বাম আমলেও কোথাও কংগ্রেস, পরের দিকে তৃণমূল কংগ্রেস স্থানীয় ভোটে জয়ী হতো, পৌরসভা নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু এখন সেই অবস্থাটা আর নেই, তৃণমূলই প্রায় সব জায়গায় নিয়ন্ত্রক। তাই সংগঠনের রাশ যার হাতে থাকবে, তারই গুরুত্ব অনেক বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটাই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে দলের তরুণ প্রজন্ম। তবে এই দ্বন্দ্ব কয়েক মাস পরের লোকসভা নির্বাচনে পড়বে কি-না, তা এখনো স্পষ্ট নয়...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার ভাতিজা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় -ফাইল ছবি

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস দলের নবীন আর প্রবীণ নেতা-নেত্রী-মন্ত্রী-বিধায়করা যেভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন, লাগাতার বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি চলছে, তা আগে কখনো এত বড় করে সামনে আসেনি। নবীনদের কেউ কেউ পুরনো নেতাদের কটাক্ষ করে বলছেন, 'তাদের সফটওয়্যার আপডেট হয়নি। পুরনো সফটওয়্যার দিয়ে হোয়াটস্‌অ্যাপ চলে না।' কেউ আবার বলছেন, নবীনরা চোখে চোখ রেখে লড়াই করবেন আর প্রবীণরা বসে দেখবেন, নির্দেশ দেবেন। প্রবীণদের দিক থেকে নতুন প্রজন্মকে 'নাবালক, নাদান' বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাতিজা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও কদিন আগে এক জনসভায় বলেছেন, নেতাদের বয়স হলে কর্মক্ষমতা কমে। তার কথায়, 'আমার বয়স কম বলে রাস্তায় থাকতে পেরেছি। এটা সত্যি কথা মানতে হবে।'

সংগঠনের নেতৃত্বে কার হাতে থাকবে? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুসারী তরুণ প্রজন্মের হাতে, নাকি প্রবীণ নেতাদের হাতে? এ বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে বলে জানান কলকাতার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী, যিনি গত কয়েক দশক যাবৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন।

'দলে কোনো দ্বন্দ্ব নেই'

দলে 'দ্বন্দ্ব' দেখতে পাচ্ছেন না তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র অধ্যাপক মনোজিৎ মন্ডল। তার কথায়, 'দলে দুই প্রজন্মের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কিছু মতপার্থক্য তো থাকতেই পারে। তবে দিন শেষে আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।'

দ্বন্দ্বের কথা এখন মানতে না চাইলেও দুই প্রজন্মের মধ্যে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতির রাশ টানতে যদিও শেষমেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বলতে হয়েছে যে, দলের কোনো বিষয়ে বাইরে মুখ খুললে শাস্তি পেতে হবে। দলীয় মুখপাত্রদের বদল করারও প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

আর প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও বলছে যে, তৃণমূলে 'নবীন-প্রবীণ কোনো দ্বন্দ্ব নেই'- সবই মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর কৌশল। দলের অন্যতম মুখপাত্র কেয়া ঘোষের কথায়, 'সবটাই আইওয়াশ হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি, হাজার দিনের ওপরে চাকরির দাবিতে শিক্ষকদের ধরনা- এসব নিয়ে যাতে মানুষ আর কথা না বলে, মিডিয়া যাতে ওসব আর না দেখায়, তাই তৃণমূল কংগ্রেসের দৃষ্টি ঘোরানোর কৌশল এটা।'

যেভাবে অভিষেকের আধিপত্য

তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছর পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে পশ্চিম ও দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত 'নবজোয়ার যাত্রা' করছিলেন। এরপর দাবি আদায়ে গিয়ে দিলিস্ন ও কলকাতার রাজভবনের সামনে দিন-রাত ধরনায় বসেছিলেন অভিষেক। তখন অনেকেই তার মধ্যে 'লড়াকু মেজাজের' ছাপ দেখেছিলেন। যেমনটা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে বিরোধী নেত্রী থাকার সময়।

তবে ওই যাত্রা বা ধরনার ইত্যাদির অনেক আগেই কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই হতে চলেছেন দলের উত্তরাধিকারী; অর্থাৎ মমতার পরে শীর্ষতম নেতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের ভাইয়ের ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেই ব্যাটন।

অবশ্য ওই দায়িত্ব পাওয়ার অনেক আগেই, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সাংগঠনিক কাজকর্ম অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছিলেন। তার উদ্যোগেই ভোটকৌশলী প্রশান্ত কুমারের সংস্থা আইপ্যাককে দায়িত্ব দেওয়া হয় দলের হয়ে নির্বাচনী কৌশল তৈরি করার। সেই প্রথম কোনো পরামর্শদাতা সংস্থা নিযুক্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ভোটের কাজে। ওই সংস্থার কর্মীরাই ঠিক করে দিচ্ছিলেন নেতা-নেত্রী বা প্রার্থীদের ভাষণ, সভার সময়সূচি ইত্যাদি। তখন থেকেই প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ বলছিলেন যে, তারা রাজনীতি অনেক বেশি বোঝেন অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাই বাইরের কোনো যুবক কী করে তার বক্তব্যের বিষয় ঠিক করে দিতে পারে!

সেসব অভিযোগ-অনুযোগ অবশ্য ধোপে টেকেনি। পরপর নির্বাচনী লড়াইতে 'প্রফেশনাল' সংস্থাকে দিয়েই ভোট করিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, আর সেই সূত্রে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ আরও বেশি করে নিজের হাতে নিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ অবস্থায় গত বছর অক্টোবর মাসের পর থেকে সেভাবে আর সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে দেখা যাচ্ছিল না অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি যেন কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। আর তখনই শুরু হয় নবীন-প্রবীণদের মধ্যে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতির পালা।

'অভিষেককে দেখেই নতুন প্রজন্ম তৃণমূলে'

দলের অন্যতম মুখপাত্র মনোজিৎ মন্ডল যদিও দ্বন্দ্বের কথা মানতে চাননি। তার মতে, দুই প্রজন্মের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে 'স্টাইল অফ ফাংশানিং'-এ ফারাক তো থাকবেই। তিনি বলেন, 'প্রবীণ নেতাদের তুলনায় কম বয়সিদের কর্মক্ষমতা বেশি হওয়া স্বাভাবিক। আবার এটাও ঠিক যে, তরুণ প্রজন্মের লাখ লাখ ছেলেমেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে এসেছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই। তারা তো চাইবেই অভিষেকের যেভাবে রাজনীতি করে, সেভাবে কাজ করতে। তবে অভিষেকসহ এই তরুণরাও কিন্তু নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মেনে চলেন। এর মধ্যে কোনো দ্বিমত কোথাও নেই। তাই দুই প্রজন্মকে নিয়েই দল চলবে। এখানে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।'

সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর কথায়, 'তৃণমূল কংগ্রেস বলছে বটে যে, কোনো দ্বন্দ্ব নেই, এগুলো সব সংবাদ মাধ্যমের তৈরি করা। তবে দ্বন্দ্ব আছে দলের ভেতরে, তা এই বয়স নিয়েই। এর শুরুটা হয়েছিল ২০১৯ সাল থেকেই। এখন জেলে রয়েছেন বা মারা গেছেন, এমন অনেক প্রবীণ নেতার সঙ্গেই সেই সময় থেকেই দ্বন্দ্ব বেঁধেছিল। তবে এটাও ঠিক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো বিরোধ নেই, সেটাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করে না কখনই। তবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে অনুগামী গোষ্ঠী রয়েছে, তারা চায় সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ করতে। অন্যদিকে, সুব্রত বক্সি বা বর্তমানে জেলবন্দি পার্থ চ্যাট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মলিস্নক, যারা প্রথম দিন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রয়েছেন, যাদের ওল্ড গার্ড বলা হয়, ওই অংশটা মনে করছেন, তারা দলে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছেন। বিরোধটা ঠিক এখানেই।'

কেন সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ?

ভারতের রাজনীতিতে দেখা যায়, মন্ত্রিত্ব বা বিধায়ক- সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো সরকারি পদ পাওয়ার জন্য নেতা-নেত্রীদের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা থাকে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসে সাংগঠনিক কাজের দখল নিয়ে যে দ্বন্দ্ব, সেটা বেশ অভিনব। জয়ন্ত চৌধুরী এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, সাড়ে তিন দশকের বামপন্থি শাসনামলেও সাংগঠনিক কাজটাকেই খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো, বিশেষ করে সিপিআই(এম) দলে। সংগঠন দেখভালের দায়িত্ব 'ওজনদার নেতাদেরই' দেওয়া হতো, তাদের বেশিরভাগ কখনই মন্ত্রী বা সরকারি পদে বসেননি।

জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, কিন্তু ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ প্রায় নিরঙ্কুশ হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। বাম আমলেও কোথাও কংগ্রেস, পরের দিকে তৃণমূল কংগ্রেস স্থানীয় ভোটে জয়ী হতো, পৌরসভা নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু এখন সেই অবস্থাটা আর নেই, তৃণমূলই প্রায় সব জায়গায় নিয়ন্ত্রক। তাই সংগঠনের রাশ যার হাতে থাকবে, তারই গুরুত্ব অনেক বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটাই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে দলের তরুণ প্রজন্ম। তবে এই দ্বন্দ্ব কয়েক মাস পরের লোকসভা নির্বাচনে পড়বে কি-না, তা এখনো স্পষ্ট নয় বলেই তিনি মনে করেন। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে