বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

তাইওয়ান কি বিপদ ডেকে আনল?

চীন তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে যাবে- এটা খুবই অনিশ্চিত। উভয় পক্ষের মধ্যে ২০১৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগও নেই। তাইওয়ান মূল চীনের অংশ- এটা মানতে সাই অস্বীকৃতি জানানোর কারণে চীন ক্ষুব্ধ হয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। শনিবারের ভোটের রায়ের আরেকটি মানে হলো, তাইওয়ানকে ঘিরে উত্তেজনা অব্যাহত থাকা এবং প্রতিদিনই চীনা জাহাজ ও সামরিক বিমানের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটতে থাকা। চীন সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে তার অসন্তুষ্টির বার্তা দিতে পারে, যেমনটি তারা করেছিল ২০২২ সালে তখনকার মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের সময়। তাইপে তখন চীনের বিরুদ্ধে দ্বীপ ভূখন্ডটিকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগ এনেছিল...
যাযাদি ডেস্ক
  ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই চিং-তে

বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে তিনি একজন ট্রাবলমেকার বা সমস্যা সৃষ্টিকারী এবং বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী। এখন তিনিই হবেন তাইওয়ানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। শনিবার দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট চীনবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত তাইওয়ানের ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) প্রার্থী উইলিয়াম লাই চিং-তে।

চীন তাইওয়ানকে নিজের ভূখন্ডের অংশ মনে করে এবং তাইওয়ান বিষয়ে চীনের এ দাবি নতুন কিছু নয়। বরং শি জিনপিং এই একত্রীকরণের বিষয়টিকে একটি লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। যদিও এই হুমকি বিগত বছরগুলোতে খুব একটা কাজে আসেনি। বরং ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগেসিভ পার্টি বা ডিপিপি'কে ভোট না দিতে চীনের বারবারের হুমকি সত্ত্বেও গত শনিবার উষ্ণ ও রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় তাইওয়ানের লাখ লাখ মানুষ ভোটকেন্দ্রে গেছেন।

তারা চিকিৎসক থেকে রাজনীতিকে পরিণত হওয়া ৬৪ বছর বয়সি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই চিং-তেকে বেছে নিয়েছেন তাইওয়ানকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। ডিপিপির জন্য এটা টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা, যে দলটিকে চীন তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষের বলে মনে করে। এখন লাই কীভাবে বেইজিংকে 'ম্যানেজ' করেন, কিংবা বেইজিং বিষয়টি কীভাবে নেয়- মূলত এটিই তার শাসন বা প্রেসিডেন্সিকে নির্ধারণ করবে।

সাই ৩.০ নাকি একটি নতুন শুরু

লাই অঙ্গীকার করেছেন, তার মেয়াদ হবে পূর্বসূরি সাই ইং-ওয়েনের আট বছরের শাসনের ধারাবাহিকতা। এমনকি তিনি শনিবার যে ভাষণ দিয়েছেন, তিনি সেখানে বেশ সতর্ক হয়েই কথাবার্তা বলেছেন এবং সংলাপ ও সহযোগিতার ডাক দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারে পূর্বসূরি সাই ইং-ওয়েনের কথাই তিনি পুনর্ব্যক্ত করেছেন- 'স্বাধীনতা ঘোষণার প্রয়োজন নেই, কারণ তাইওয়ান এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের নাম চীন প্রজাতন্ত্র- তাইওয়ান'।

যদিও লাই অনেক বেশি সতর্ক এবং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সাইয়ের চেয়ে, তাকে বেশি স্পষ্টভাষী বলেই বিবেচনা করা হয়। তিনি ডিপিপির কমিটিতে উঠে এসেছিলেন 'নিউ ওয়েভ' অংশের সদস্য হিসেবে যারা তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে।

লাই ও তার রানিং মেট সিয়াও বি-খিম দুজনই বেইজিংয়ের কাছে খুবই অপছন্দের ও অবিশ্বস্ত। তাদের দুজনের মূল চীনা ভূখন্ড ও হংকং ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে চীন। সিয়াও এর বাবা তাইওয়ানিজ কিংবা মা আমেরিকান। তিনি নিজেও সম্প্রতি আমেরিকায় তাইওয়ানের প্রতিনিধি ছিলেন।

এসব কারণে চীন তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে যাবে- এটা খুবই অনিশ্চিত। উভয় পক্ষের মধ্যে ২০১৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগও নেই। তাইওয়ান মূল চীনের অংশ- এটা মানতে সাই অস্বীকৃতি জানানোর কারণে চীন ক্ষুব্ধ হয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

শনিবারের ভোটের রায়ের আরেকটি মানে হলো, তাইওয়ানকে ঘিরে উত্তেজনা অব্যাহত থাকা এবং প্রতিদিনই চীনা জাহাজ ও সামরিক বিমানের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটতে থাকা।

চীন সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে তার অসন্তুষ্টির বার্তা দিতে পারে, যেমনটি তারা করেছিল ২০২২ সালে তখনকার মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের সময়। তাইপে তখন চীনের বিরুদ্ধে দ্বীপ ভূখন্ডটিকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগ এনেছিল।

চীন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপও বাড়াতে পারে। তাইওয়ানের বিভিন্ন কোম্পানি, পণ্য ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে। চীনা সামরিক বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য লাইয়ের কৌশল হতে পারে- সাই যা করে গেছেন তাকে অনুসরণ করা।

তিনি তাইওয়ানের সামরিক বাহিনীর জন্য আরও ব্যয়, সাবমেরিন তৈরির কর্মসূচি চালু রাখা এবং আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। সাই বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন।

তবে আমেরিকার কাছে কিছু বিষয় উদ্বেগের হতে পারে যে, লাইয়ের শাসনকাল তার স্বাধীনতাকামী রাজনীতির অভিজ্ঞতার কারণে কোনো উসকানি তৈরি করে কি-না। যদিও তার রানিং মেট সিয়াও বাইডেন প্রশাসনের কাছে আশ্বাসমূলক। হয়তো তিনি আমেরিকাকে আশ্বস্ত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন, লাই বেইজিংকে কোনো উসকানি দেবেন না বলে বিশ্বাস করা যায়।

শি জিনপিংকে চুপ থাকা শিখতে হবে

লাই যতই সতর্কতার সঙ্গেই খেলুন না কেন, বেইজিং তার জয়ের মধ্যে যে বার্তা পেয়েছে, সেটি উপেক্ষা করতে পারে না। নির্বাচনটি বলছে, প্রতিযোগিতাটি ছিল খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতার, কিন্তু ডিপিপি জিতেছে বড় ব্যবধানে।

নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর ডিপিপির একজন সমর্থক বলেছেন, 'তারা চীনকে বলেছে, আমরা আর তোমার কথা শুনব না। আমাদের ভবিষ্যৎ আমরাই ঠিক করব। সুতরাং আমাদের নির্বাচনের সময় শি জিনপিংকে চুপ থাকা শেখা প্রয়োজন।'

হউ ইউ-ই এবং প্রধান বিরোধী দল 'কেএমটি' তাদের প্রচারে যে ভয়টি তুলে ধরেছে, তা হলো চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করতে পারে। কেএমটির জয় হলে সেটি সম্ভবত তাইওয়ানে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে সরিয়ে দিত বরং বেইজিং তখন ইউ-এর সঙ্গে সংলাপ করত।

শি জিনপিং তাইওয়ানে কেএমটির সবশেষ প্রেসিডেন্ট মা ইং জেও-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন ২০১৫ সালে। ১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধের পর এটাই ছিল চীন ও তাইওয়ানের নেতাদের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ। যারা কেএমটির বিরোধিতা করে, তাদের অভিযোগ হলো- দলটি চীনের কাছে আত্মসমর্পণকারীর মতো আচরণ করে এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় আটকে দেওয়া ও সামরিক সেবা কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষাকে গুরুত্ব দেয় না।

এই ভয়ও আছে কেএমটি সরকার তাইওয়ানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। এর ফলে আমেরিকার মতো সহযোগী দেশগুলো প্রশ্ন তুলতে পারে যে, তাইওয়ান যেখানে নিজেই তার প্রতিরক্ষাকে গুরুত্ব দেয় না, সেখানে তারা কেন এগিয়ে আসবে।

তাইওয়ান এখন জিডিপির আড়াই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। যা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ওই অঞ্চলের অন্য দেশগুলো বা আমেরিকার তুলনায় অনেক কম। এসব কারণে ভোটারদের পছন্দ করার সুযোগ ছিল অনেকটাই পরিষ্কার। তার বেইজিংয়ের দিক থেকে আসা সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সচেতন এবং তারা চায় সংলাপ।

কেএমটি অবশ্য তাইওয়ানের তরুণ ভোটারদের কাছে কোনো আবেদন নিবেদনই করেনি, যারা নিজেদের চীনা না ভেবে তাইওয়ানিজ ভাবতে পছন্দ করে। গত কয়েক মাসে তাইওয়ানের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। এর নির্বাচনটি ছিল ব্যাপক আলোচনার বিষয় এবং এর গণতন্ত্র অল্প দিনের। তবে ভোটারদের উৎসাহ ছিল স্পষ্ট।

যদিও একই সময় বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়া, বেতন না বাড়ানো ও চাকরির সুযোগ কমে যাওয়ার কারণে ডিপিপির ওপর থেকেও দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল অনেক ভোটার। এসব কারণে ডিপিপি জিতলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। কেএমটিকে সঙ্গে নিয়ে 'তাইওয়ান পিপলস পার্টি'র অবস্থান শক্ত হয়েছে আইনসভায়, যা লাইয়ের এজেন্ডাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট লাইয়ের পথ খুব একটা সহজ ছিল না।

বিরোধীদল কেএমটি এবং তাইওয়ান পিপলস পার্টি দুইই চীনের সঙ্গে 'ট্রেড সার্ভিসেস প্যাক্ট' নতুন করে শুরু করতে আগ্রহী। এই দুই দলকে সামাল দেওয়া ছাড়াও বিশ্বের অন্য অংশে আরেকটি নির্বাচনের ওপরই নির্ভর করবে তার শাসন আমল কেমন যাবে সেটি। কারণ আমেরিকায় নির্বাচন হবে এ বছরই। ফলে হোয়াইট হাউসে যদি আবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে আসেন, তাহলে তার মতো খুবই ভিন্ন ধরনের একজন মিত্রকে পাওয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট লাইকে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে