বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মাটির প্রেম ও প্রান্তিক কৃষক

বাংলাদেশ পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি দারিদ্র্র্য বিমোচন ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর মাঝে বিরাজমান পুষ্টি অবস্থা উন্নয়নেও উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে চলেছে।
কামরুজ্জামান তোতা
  ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
মাটির প্রেম ও প্রান্তিক কৃষক

আজও মাটির প্রেমিক ও প্রান্তিক কৃষকই সমাজের প্রধান চালিকা শক্তি। তাই এই চালিকা শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে প্রকৃতপক্ষে সমগ্র সমাজের দুর্বলতা অবশ্যম্ভাবী। সে কারণে কৃষকদের উন্নতির জন্য বাংলা তথা সমগ্র দেশকে সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই একটি দেশ সেই প্রাথমিক চালিকা শক্তির ওপর নির্ভর করে কাঙ্ক্ষিত উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারবে, নচেৎ নয়। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জুড়ে আছে এ দেশের কৃষি ও কৃষক। এ দেশের যে সোনার মানুষ দিনের পর দিন পরিশ্রম করে আমাদের সারাদেশের খাদ্য শস্যের জোগান দিয়ে থাকেন জাতীয় অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, শিল্পায়নে, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে কৃষি ও কৃষকের যে অবদান তার তুলনা নেই। সরকার ঘোষিত ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মুজিব শতবর্ষ এবং মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে 'ভরসার নতুন জানালা' খুলে দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এ ধরনের কৃষিঋণ বিতরণে লক্ষ্যমাত্রা আছে ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণের সুদ সহায়তা হিসেবে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ঋণের মধ্যে রয়েছে শস্য ঋণ, কৃষি ইকুইপমেন্ট ক্রয়ে ঋণ, সেচযন্ত্র ক্রয়বাবদ ঋণ, গবাদিপশু খামার ও পোল্ট্রি খামার, মৎস্য চাষ। বাংলাদেশ পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি দারিদ্র্র্য বিমোচন ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর মাঝে বিরাজমান পুষ্টি অবস্থা উন্নয়নেও উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে চলেছে। সবজি উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ জনসংখ্যার অনুপাতে ক্ষুদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য খাদ্য উৎপাদনে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আজ সারা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। করোনা সংকটের কালে সবচেয়ে বেশি ভরসা জুগিয়ে গেছে কৃষক, মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষককে আহত করলেও কাবু করতে পারেনি। করোনা কালের বীর তো তারাই। ২০২১-২০২২ সালে দুই দফার বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সামলে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন অনাদিকালের সেই কৃষক। লকডাউনের মধ্যেও যে মানুষ কষ্টে হলেও খেতে পেয়েছে, সেটাই কৃতিত্ব। বাংলাদেশে করোনাকালে খাদ্য উৎপাদন বহাল অবস্থায় ছিল, তার কৃতিত্ব বৃহত্তর কৃষক সমাজের। সত্যিকারের সুপারম্যান, কাজের বেলায় একেবারে পালোয়ান। যা কিছু সংকট তা কেবল মুনাফার স্বার্থে ব্যবসায়ীদের তৈরি। বাজারে চাল, সবজি ও মাছের অভাব নেই। শীতের সবজি- যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, সাদা মুলা, লাল মুলা, শিম, সবুজ মুক্তাদানার মতো মটরশুঁটি, লাউ, নতুন আলুর পেঁয়াজের কলির ঘ্রাণে মন ভরে যায় কৃষকদের অপরূপ শিল্পকর্ম ফলানো বর্ণিল জমিতে। এ যেন কবি জসীমউদ্‌দীনের নকশিকাঁথার মাঠ। ১৮৭১ সালে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের প্রথম আদম শুমারিতে প্রধান শুমারিকার বেভারলি সাহেব লিখেছেন, বাঙালিদের দেখতে নাজুক লাগলেও জলে ও ডাঙায় বিচরণকারী এ উভচর- যা সামলাতে পারে, তা করতে গিয়ে যে কোনো হিন্দুস্থানী ভেঙে পড়ত। বাংলাদেশের কৃষি খাতের সমস্যাগুলোর সমাধান করে অতি শিগগিরই কৃষকের উন্নয়নের জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এর মধ্যে কিছু পদক্ষেপ ও ত্রম্নটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা দূর করতে হবে। ১. কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ২. কৃষকদের হাতে কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি তুলে দিতে হবে। ৩. ভূমিহীন গরিব কৃষকদের ভূমির ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. শুকনো মৌসুমে জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র ও বিদু্যৎ সরবরাহ করতে হবে। ৫. কৃষকদের স্বল্প বা বিনা সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৬. কৃষি বাজারের সব ত্রম্নটি দূর করে কৃষকের ন্যায্যমূল্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ৭. কৃষিপণ্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। এক নজরে বাংলাদেশ কৃষি পরিসংখ্যান - # মোট পরিবার= ২,৮৬,৯৫,৭৬৩ ২. মোট কৃষি পরিবার= ১,৫১,৮৩,১৮৩ ৩. কৃষি বহির্ভূত পরিবার= ১,৩৫,১২,৫৮০ ৪. মোট আবাদযোগ্য জমি= ৮৫.৭৭ লাখ হেক্টর ৫. আবাদযোগ্য পতিত= ২.২৩ লাখ হেক্টর ৬. নিট ফসলি জমি= ৭৯.৪৭ লাখ হেক্টর ৭. মোট ফসলি জমি= ১৫৪.৩৮ লাখ হেক্টর ৮. জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান= ১৪.১০ (স্থির মূল্যে) ২০১৭-১৮ (ঢ়) শ্রমশক্তি জরিপ -২০১৬-১৭, বিবিএস ৯. জিডিপিতে শস্য খাতের অবদান= ৭.৩৭ (স্থির মূল্যে) ২০১৭-১৮ (ঢ়) ১০. কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি= ৪০.৬ (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস), ২০১৮) # ২০১৯-২০ মৌসুমে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে আমন আবাদ এরিয়া ৫% বৃদ্ধি পায়, এর মধ্যে ৩.১৩ লাখ হেক্টর বোনা, ৮.৫১ লাখ হেক্টর স্প্যানীয় জাতের এবং ৪৭.১৯ লাখ হেক্টর জমিতে উপশি রোপা আমনের চাষ হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশে সবজি বীজের মোট কৃষি তাত্ত্বিক চাহিদা ছিল ২,২৯১ মে. টন (যদিও প্রকৃত চাহিদা ৪,৫০০ মে. টন); যার শতকরা ৩.২০ ভাগ (৭৩ মে. টন) সরকারি সংস্থা তথা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বীজ বিতরণ করে, যেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রায় শতকরা ৮০.৮০ ভাগ (১,৮৫৪ মে. টন) বীজ বিতরণ করে এবং বাকি শতকরা ১৬ ভাগ কৃষক তার নিজের সংরক্ষিত বীজ ব্যবহার করে। কৃষকের নিজের চাহিদা মতো বীজ যদি নিজে সঠিকভাবে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারে তাহলে একদিকে বীজের মান নিশ্চিত করা যায়, অন্যদিকে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না এবং খরচও কম, দেশে ফসল কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকার আরও যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কৃষির উপকরণ বিতরণ বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আরও গতিশীল হয়েছে 'খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি' প্রকল্পের মাধ্যমে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ২৫% কম মূল্যে ৩৫টি জেলায় ৩৮ হাজার ৩২৪টি বিভিন্ন প্রকার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। তাছাড়া বিএআরআই এবং বিআরআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি মোট মূল্যের ৬০% পর্যন্ত ভুর্তুকি মূল্যে কৃষকের কাছে সরবরাহ করে যাচ্ছে। এত কিছু জানার পরে যেন কৃষি খাতে অভাব অনটন থেকেই যায়। \হএ প্রসঙ্গে সবার প্রথমে উলেস্নখ করতে হয় বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া সবুজ বিপস্নবের কথা। এই সবুজ বিপস্নবের আঁচ এসে পড়েছিল বাংলার কৃষকদের ওপরেও। এছাড়া কৃষকদের প্রাথমিক সমস্যা দূরীকরণের জন্য জমিদারি প্রথার অবলুপ্তি এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জমির পাট্টাদানের কথাও উলেস্নখ করতে হয়। বাজেট হতে হবে কৃষিবান্ধব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দেশকে সার্বিকভাবে উন্নতি করতে গেলে সেই দেশের কৃষক সমাজকে সবার আগে উন্নত হতে হয়। তাই কৃষক সমাজের সমস্যাবলী দূর করতে না পারলে দেশের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। এই চরম সত্য অনুধাবন করতে পেরে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের নেতারা কৃষক সমাজের সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছন। তাছাড়া বর্তমানে প্রতি বছর সরকারের তরফ থেকে কৃষকদের প্রয়োজনীয় ঋণদান এবং ফসল ফলানোর জন্য উপযোগী যন্ত্রাদি ও বীজ কেনার জন্য বিভিন্ন প্রকার ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে। কৃষকদের আয় নিশ্চিত করার জন্য দেওয়া হয়ে থাকে নূ্যনতম সমর্থন মূল্য। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার ফসলের গুণগতমান উন্নয়ন ও পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য কৃষিকে আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ করছে। এই লক্ষ্যে মাটির নিচে সেন্সর বসানো এবং উপর থেকে জিও স্পেশাল সার্ভের মাধ্যমে ডিজিটাল ম্যাপিং করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জিও স্পেশাল সার্ভের মাধ্যমে মাটির গুণগতমান সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া যাবে। মাটির মান বিবেচনায় নিয়ে কৃষকরা সময়মতো শস্য রোপণ ও কর্তন করতে পারবেন। তারা জানতে পারবেন, কোন মাটিতে কোন ফসল ভালো হবে। বায়ার, বিশ্বব্যাপী 'বেটার ফার্মস-বেটার লাইভস' উদ্যোগের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার প্রায় ২০ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে বেটার লাইফ ফার্মিং কেয়ার প্যাকেজের আওতায় বিনামূল্যে নানা ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। এর আওতায় উচ্চফলনশীল হাইব্রিড বীজ, বালাইনাশক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ, নিরাপত্তামূলক প্রশিক্ষণ উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। এই কর্মসূচির আওতায় গত আমন ও বোরো মৌসুমে কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ৫৯ জেলার ২৪২টি উপজেলায় এক লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে উন্নত হাইব্রিড বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। কার্যক্রমের বাড়তি উদ্যোগ হিসেবে দেশের আরো ১৫ হাজার প্রান্তিক কৃষককে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। বপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি, উন্নত বীজ, স্থানীয় চাহিদা পূরণ, বালাই ব্যবস্থাপনা ও উন্নত প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। মনে রখতে হবে ২০২৩ সালে নতুন চেলেঞ্জ খাদ্য উৎপাদনে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে হবে নতুন মেন্ডেট নিয়ে বাংলাদেশের কৃষিজমি কমেছে, জনসংখ্যা ও ভোগ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, তবু স্বাধীনতার সময়ের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জায়গায় এখন সতেরো-আঠারো কোটি মানুষকে খাইয়েও রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের শস্য। কামরুজ্জামান তোতা : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে