বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি

তারাপদ আচার্য্য
  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

ভাষা আন্দোলন বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি একই সূত্রে গাথা। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণে সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। একাডেমির সভাপতি সৈয়দ মুর্তাজা আলী এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির পরিচালক প্রফেসর কবীর চৌধুরী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই দিনই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। একমাত্র কুমিলস্নার শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ করেন এবং উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কোনো বাঙালি মুসলমান প্রতিবাদ করেননি। এটা লজ্জাজনক ইতিহাস। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার আন্দোলন ছিল না; বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত ছিল। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করব না। কারণ, তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনোদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে। স্বাধীনতার পর আমাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে আচরণ করা হয়েছে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের দালাল বলা হয়েছে। এমন কি ভাষা আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানি করা হয়েছে বলা হতো। বাঙালি হিসেবে আমরা অনেক উদারতার পরিচয় দিয়েছি। তা না হলে আমরা বাংলাকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাতে পারতাম। কিন্তু সেদিন আমরা উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলাম। বাঙালির স্বজাত্যবোধকে টুঁটি চেপে হত্যার জন্যে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বার বার এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত হেনেছে, আর তাকে প্রাণ দিয়ে প্রতিহত করেছে এ দেশের তরুণরা। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ক'জন আছেন? বিবেকের কাছেই তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আপনাদের লেখনি দিয়ে বের হয়ে আসা উচিত ছিল এ দেশের গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল এই বাংলা একাডেমি। ১৯৫২ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এই ভবনে বসেই ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলির আদেশ দিয়েছিলেন। তাই, যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালে ক্ষমতায় এসে এখানে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। এই বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচারী সরকার কত খেলাই না খেলেছে, তা এ দেশের মানুষের জানা আছে। বাংলা একাডেমির মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ৩ লাখ টাকা সরকার বার্ষিক বরাদ্দ করেছে। এর জন্যে কাকে দোষ দেব! যারা এসব করছে, সে আমলারা তো এ দেশেরই ছেলে। বাংলা একাডেমির ভিতরের সব কথাই আমি জানি। লোক বদল করে নতুন নতুন লোক এনে বাংলা ভাষাকে ইসলামিকরণের যে চেষ্টা চালানো হয়েছে তাও জানি। স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনে ফেব্রম্নয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা একাডেমি যে সপ্তাহ পালন করছে সে সপ্তাহ বাংলাদেশের জীবনে এক কঠিন সপ্তাহ। ফেব্রম্নয়ারির এই দিনেই বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা, এই সপ্তাহেই কুর্মিটোলার বন্দিশিবিরে হত্যা করা হয়েছে সার্জেট জহুরুল হককে, এই সপ্তাহেই শহীদ হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা, আর এই সপ্তাহেই কারফিউ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে আত্মাহুতি দিয়েছে এ দেশের অসংখ্য মায়ের অসংখ্য নাম না জানা সন্তান। স্বৈরাচারীচক্র সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে কোনো কোনো প্রফেসরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু কই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক তো সে স্বৈরাচারী কার্যকলাপের প্রতিবাদে তখন পদত্যাগ করেননি। তখন অধ্যাপকরা একযোগে পদত্যাগ করলে আন্দোলনে এত রক্তক্ষয়ের প্রয়োজন হতো না।

মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। ভাষার প্রতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। এই মুক্ত পরিবেশে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অতীত ভূমিকা ভুলে স্বজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলুন। জনগণের জন্যেই সাহিত্য। এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনির মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ ছিল সুদূরপ্রসারী এবং গুরুত্বপূর্ণ।

উলেস্নখ্য, ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের রক্তধারায় প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি উদ্বোধনের দিন প্রধান অতিথি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের বক্তব্যেও উঠে আসে একাডেমি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে ভাষা আন্দোলনের প্রেরণার কথা, 'সাড়ে চার কোটি পূর্ব-বঙ্গবাসীর মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং তাহাকে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার যে সার্বজনীন দাবি, মূলত তাহা হইতেই বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা জন্ম লইয়াছে। কাজেই বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা পূর্ব বাংলার ভাষার শাশ্বত দাবি ও ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনেরই প্রথম বাস্তব স্বীকৃতি।

মূলত ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানের ঢেউয়ের তরঙ্গ এসে লাগে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে। প্রতিবাদী কবিতার ধ্বনি-বারুদ আর দেশাত্মবোধক গানের অগ্নিসুরে উত্তাল হয়েছে ফেব্রম্নয়ারি '৬৯, '৭০, '৭১-এর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। ঊনসত্তরের একুশের অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হক 'হারাধনের দশটি ছেলে', নির্মলেন্দু গুণ 'গণতন্ত্র' ও 'প্রেমাংশুর রক্ত চাই' আর একাত্তরে একুশের আয়োজনে বাংলা একাডেমির বটতলায় শামসুর রাহমান পাঠ করেছিলেন তার স্মরণীয় কবিতা 'ফেব্রম্নয়ারি ১৯৬৯' 'শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।/ একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।' ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি বাংলা একাডেমির সপ্তাহব্যাপী একুশের অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করছেন বঙ্গবন্ধু।

৬৮ বছর ধরে বাংলা একাডেমি অমর একুশের স্মৃতি ও মর্মবাণীকে ধারণ করেছে নানা মাত্রায়। স্বাধীন বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের চেতনাবাহী জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি একুশের শহীদ স্মরণে প্রকাশ করেছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, দলিলপত্র, ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের জীবনী, ঢাকাসহ বাংলার প্রান্তিক অঞ্চলে একুশের ইতিহাস, একুশের স্মৃতিচারণা, একুশের সংকলনপঞ্জি, একুশের কবিতা, একুশের গল্প, একুশের উপন্যাস, একুশের নাটক, ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা, প্রথম শহীদ মিনার এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ইতিহাস। একাডেমির নিয়মিত বার্ষিক প্রকাশনা একুশের প্রবন্ধ ও একুশের স্মারকগ্রন্থ। ১৯৮৫ থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রম্নয়ারি আয়োজন করা হয় অমর একুশে বক্তৃতা। আশির দশকে একাডেমির সদ্য প্রয়াত মহাপরিচালক মনজুরে মওলার উদ্যোগে ১০১টি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা গ্রন্থমালার শিরোনাম ছিল 'ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা'। 'একুশে আমাদের পরিচয়' এ বক্তব্য ধারণ করে ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা, যা এখন বিশ্বের দীর্ঘ সময়ব্যাপ্ত ও সাড়া জাগানো বই-উৎসব। সূচনাপর্বে যেমন একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করেছেন ভাষাসংগ্রামী বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, তেমনি ১৯৮৫-তে সংস্কারকৃত ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবন উদ্বোধনের জন্যও বাংলা একাডেমি নির্বাচন করেছে ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের জননী রাফিজা খাতুনকে। বাংলা একাডেমির বর্ধমান ভবনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর।

মনে রাখতে হবে, ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি বাঙালির ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণা, সাংস্কৃতিক জাগরণ। এই জাগরণকে আরও উজ্জীবিত করতে হবে।

তারাপদ আচার্য্য : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে