শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে চাই স্মার্ট নাগরিক

নতুনধারা
  ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

আধুনিক বিশ্বের ক্রমাগত প্রযুক্তিগত বিপস্নব, শিল্পোন্নয়ন, শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন একটি যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। ক্ষুদ্র আয়তনের এই দেশটি অত্যন্ত জনবহুল। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র কিংবা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানো একটি কঠিন চ্যালেঞ্জই বটে। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা ভাগ্যের অনুকূলে ঘুরতে শুরু করলেও মাঝপথে বাদসাধে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলমান এই যুদ্ধের প্রভাব বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করে চলছে। পৃথিবীব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে বৈশ্বিক মন্দা ও নানামুখী সংকট। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব, অভ্যন্তরীণ বহুমুখী সংকট উতরে এগিয়ে যাওয়া বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য বরাবরি কঠিন চ্যালেঞ্জ। তথাপি কূটকৌশলী পন্থা অবলম্বন করে ভারসাম্যের পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলেছে এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে আধুনিক রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।

বলা হয়ে থাকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকাটাই যেন মানুষের জীবনের একটি অন্যতম লক্ষ্য ও পাথেয়। এই চ্যালেঞ্জ যেমন মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য দেশ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। কারণ মানুষ এবং রাষ্ট্র একটি অপরটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। আর রাষ্ট্রের সেই লক্ষ্য অর্জনে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও বাস্তবায়ন করে আসছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার যে প্রয়াস সেটি বাস্তবায়নে মূলত ৪টি ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ৪টি ভিত্তি হলো ১. স্মার্ট সিটিজেন ২. স্মার্ট ইকোনমি ৩. স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। এই চারটি বিষয় স্মার্ট বাংলাদেশের নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে অর্থাৎ এই ৪টি ভিত্তি সুষমভাবে অর্জিত হলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করতে পারব।

স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে প্রথমত যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেটি হলো স্মার্ট সিটিজেন বা স্মার্ট নাগরিক। স্মার্ট নাগরিক বলতে একজন শিক্ষিত, ডিজিটাল বিভিন্ন বিষয় ও জ্ঞানে দক্ষ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং দেশ ও জাতির প্রতি অনুগত নাগরিককে বোঝায় যিনি তার অর্জিত শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতার একটি পরিপূর্ণ সমম্বয় ঘটিয়ে কর্মক্ষেত্রে অর্জিত জ্ঞানের পরিস্ফুটন ঘটাতে পারবেন, কাজে লাগাতে পারবেন, দেশের একজন দক্ষ ও পরিপূর্ণ মানবসম্পদ হিসেবে কাজ করবেন। স্মার্ট নাগরিক হতে হলে প্রতিটি নাগরিককে তার নিজ নিজ কাজকে ভালোবাসতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা ও বিন্দু বিন্দু জল যেমন মহাদেশ আর সাগর তৈরি করে ঠিক তেমনি ছোট ছোট পরিবর্তন-ই দেশের জন্য একটা সময় অনেক বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা এশিয়ার দেশ জাপানের কথা উলেস্নখ করতে পারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই জাপানকে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছতে সাহায্য করেছে সেই দেশের নাগরিকরা। বলাই বাহুল্য, জাপান অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও পরিশ্রমী একটি জাতি। তাদের এই সফলতার পিছনে নিয়ামক হিসেবে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে তাদের দেশের নাগরিক। এ ছাড়া তারা নিজ নিজ কাজ ও দায়িত্বের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। তাদের কতিপয় এসব কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, একটি দেশের স্মার্ট সিটিজেন বা নাগরিকরাই কেবল সেই দেশের চিত্র পুরোপুরি পাল্টে দিতে সক্ষম। উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে আমরা একই চিত্রপট দেখতে পারব। বাংলাদেশকে একটি সভ্য ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে দেশের নাগরিকদের সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে দেশের নাগরিকরাই। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ যত বেশি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুগঠিত হবে সেই রাষ্ট্রের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা তত বেশি জোরালো হবে। আর অগ্রযাত্রার এই পথকে মসৃণ করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নাগরিক পর্যায়ে দক্ষতাভিত্তিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাগরিকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, ডিসিপিস্নন এবং বাস্তবধর্মী বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং বাস্তবজীবনে সেই জ্ঞানের প্রতিফলন করতে হবে ও পরিধি সম্প্রসারণে এগিয়ে আসতে হবে। স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে প্রয়োজনে সরকারকে একটি সুনির্দিষ্ট সেক্টর তৈরি করে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা, পদক্ষেপ গ্রহণ ও সর্বস্তরের নাগরিকদের দক্ষতা উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করা সমীচীন হবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে সরকার বদ্ধপরিকর। প্রয়োজন ব্যক্তি পর্যায়ে সুশিক্ষা অর্জন, সদিচ্ছা, সচেতনতা ও পরিশ্রম। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে যৌথ প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। কেবল যৌথ প্রচেষ্টাই পারবে যে কোনো অন্তরায়কে রুখে দিতে। স্মার্ট নাগরিক তৈরির পথে প্রধান কিছু অন্তরায় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেকারত্ব অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা। সরকারকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিকল্প উপায় অনুসন্ধানের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যাতে স্বল্প সময়ে এটির সমাধানের নূ্যনতম কোনো উপায় বের করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে, নাগরিক পর্যায় থেকেও বেকারত্ব দূরীকরণে স্ব স্ব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শুধু সরকারি চাকরির আশায় বেকার না থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তার মতো স্বাধীন পেশার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। নিজ নিজ কাজকে ভালোবাসতে হবে পাশাপাশি প্রতিটি নাগরিককে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সচেতন থাকতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এই যুগে প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার করার মাধ্যমে নিজেদের যুগপোযোগী ও যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে চলার মতো সক্ষমতা ও যুতসই করে গড়ে তুলতে হবে। ফ্রি-ল্যান্সিং-এর মতো মুক্ত ও স্বাধীন পেশার পরিধি বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিপন্থি সর্বপ্রকার কার্যক্রম থেকে প্রতিটি নাগরিককে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সমাজ ও দেশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় গুণাবলি অর্জন করতে পারলেই একজন নাগরিকের পক্ষে স্মার্ট নাগরিক হয়ে ওঠা সম্ভবপর হবে। শুধু স্মার্ট নাগরিকরাই পারবে স্মার্ট ইকোনমির যথাযথ বাস্তবায়ন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা ও স্মার্ট সোসাইটির একটি পরিপূর্ণ সমম্বয় সাধন করতে, আর এটি করা সম্ভব হলেই একটি আধুনিক ও যুগপোযোগী স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে।

মারজান হোসেন

রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে