শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির শিকার প্রধানত দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ- তথা শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, কৃষক, পেশাজীবী, কারিগর, নির্দিষ্ট আয়ের কর্মচারী প্রমুখ। মেহনতি মানুষের মজুরি বাড়ে না, কৃষক ফসলের যুক্তিসঙ্গত দাম পান না, কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগতই বাড়তে থাকে, এমনকি লাফিয়ে লাফিয়েও। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা 'প্রকৃত আয়' কমতে থাকে। শুরু হয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের যাতনা।
দয়াল কুমার বড়ুয়া
  ২০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

পবিত্র রমজান মাস আসছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। এক দফা দাম বেড়েছে শবেবরাতের আগে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, বাজারে সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসেরই বাজারে প্রচুর মজুত আছে। এর পরও বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তির দিকে।

আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত, সরবরাহ, মূল্য পরিস্থিতিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গত রবিবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে পবিত্র রমজান মাসে কোনোভাবেই যাতে দ্রব্যমূল্য না বাড়ে, সে বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে বাণিজ্য সচিবকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবারের রোজায় দেশে অনেক খাদ্য ও নিত্যপণ্যের মজুত আছে। জনগণকে অহেতুক উদ্বিগ্ন হয়ে একবারে অনেক পণ্য না কেনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এবার সরকারের খাদ্য মজুতের পরিমাণ অনেক জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেছেন, রোজার সময় অবৈধ মজুত ও বাজারে সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে। মোবাইল কোর্ট চালু রাখার কথাও বলেছেন তিনি। জানিয়েছেন, মনিটরিং জোরদারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পণ্য পরিবহণে যাতে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয় সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নানা উপলক্ষে আমাদের বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। দাম বাড়ানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের কোনো উপলক্ষ লাগে না। ধর্মীয় উৎসব এলে তো কথাই নেই। বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাজারে দাম বাড়ায় বলে অভিযোগ আছে। এবারও রোজার আগে ভোগ্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর এবং অন্যান্য ফলমূলের রোজায় চাহিদা বাড়ে, এমন পণ্যের বাড়তি আমদানি হয়েছে। কিন্তু বাজারে তার প্রভাব নেই।

বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেও সংগঠিত নয়। এর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। এ প্রবণতা যদি চলতেই থাকে, তাহলে ভোক্তাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশের বাজারে একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। এই সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, এমন কথাও চালু আছে। বাজারের নিয়ন্ত্রণ সরকার নিতে না পারলে কোনোভাবেই পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হবে না। কাজেই সরকারকে মূল ভূমিকা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মনিটরিং বাড়াতে হবে। পণ্য যেন ভোক্তাসাধারণের কাছে সহজলভ্য হয়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে চাল-ডাল-শাকসবজিসহ নিত্যপণ্য কিনতে। সরকার সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখতে কেউ যাতে অতি মুনাফার আশ্রয় না নেয়, সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। পরিবহণ চাঁদাবাজি বন্ধ করেও নিত্যপণ্যের দামের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা জনগণের কাছে সরকারের সুকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সরকারের কাছ থেকে মানুষ যে দু'টি বিষয় প্রত্যাশা করে, তার একটি হলো আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ, অন্যটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ। এ ব্যাপারে সরকার তাদের সাধ্যের মধ্যে সবকিছু করবে, জনগণ এটাই দেখতে চায়।

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পালস্না দিয়ে জীবন চালাতে গিয়ে সৎ ও সচ্ছল মানুষের জীবনে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন সীমিত থাকে, তেমনি জিনিসপত্রের বাজার দর দ্বারাও তা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিত্তবানদের জন্য দ্রব্যমূল্য প্রত্যক্ষভাবে কখনোই তেমন সমস্যা নয়। কারণ তাদের আয় প্রায় সীমাহীন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যে আয় করে তা দিয়ে তাকে হিসাব করে চলতে হয়। মানুষের আয় যতটা বাড়ে সেই তুলনায় যদি জিনিসপত্রের দাম বেশি বৃদ্ধি পায় তাহলেই তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্রয়ক্ষমতাই হলো তার 'প্রকৃত আয়'। 'প্রকৃত আয়' বৃদ্ধি না পেয়ে যদি একই জায়গায় স্থির থাকে তাহলেই শুরু হয় আশাভঙ্গের নিদারুণ যন্ত্রণা। আর 'প্রকৃত আয়' কমে গেলে যে যন্ত্রণা- তার মাত্রার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। গণমানুষের আয়ের পরিমাণ ও বাজার দর- এ দুইয়ের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করাটাই হলো দ্রব্যমূল্য সমস্যা সমাধানের আসল উপায়। বাজার দর বৃদ্ধির তুলনায় আয় বাড়ল কিনা, কিংবা উল্টো করে বললে, আয় বৃদ্ধির তুলনায় বাজার দর কম বাড়ল কিনা- সেটিই দেখার বিষয়। চাল-ডাল-তেল-চিনির দাম যদি পাঁচগুণ বাড়ে তাতে মানুষের কোনো যন্ত্রণাই তেমন থাকবে না যদি তাদের সবার আয় পাঁচগুণের বেশি বৃদ্ধি পায়।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির শিকার প্রধানত দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ- তথা শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, কৃষক, পেশাজীবী, কারিগর, নির্দিষ্ট আয়ের কর্মচারী প্রমুখ। মেহনতি মানুষের মজুরি বাড়ে না, কৃষক ফসলের যুক্তিসঙ্গত দাম পান না, কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগতই বাড়তে থাকে, এমনকি লাফিয়ে লাফিয়েও। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা 'প্রকৃত আয়' কমতে থাকে। শুরু হয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের যাতনা।

'প্রকৃত আয়' আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চলে যায় অনেক মাস-বছর। ততদিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়ে তার 'প্রকৃত আয়'কে আবার পেছনে ফেলে দেয়। ফলে দ্রব্যমূল্যের যন্ত্রণা চলতে থাকে নিরন্তর। দ্রব্যমূল্যের 'পাগলা ঘোড়া'র যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য মানুষের 'প্রকৃত আয়ের' ধারাবাহিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য একসঙ্গে নিতে হবে দুই দিক থেকে পদক্ষেপ। প্রথমত, ব্যাপক জনগণের ধারাবাহিক আয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পণ্য মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মূল্য এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে- যেন তা স্থিতিশীল থাকে কিংবা বৃদ্ধি পেলেও তা যেন কখনোই আয় বৃদ্ধির সাধারণ হারের ঊর্ধ্বে না ওঠে।

দয়াল কুমার বড়ুয়া : কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, কো-চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে