সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

সংস্কারের জন্য দরকার জনগণের একাত্মতা

দেশের অর্থনীতি নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। ছোট-বড় সব ব্যবসার ক্ষেত্রেই নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ সবকিছুই যেন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য সরাসরি সম্পৃক্ত। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
আর কে চৌধুরী
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সংস্কারের জন্য দরকার জনগণের একাত্মতা
সংস্কারের জন্য দরকার জনগণের একাত্মতা

যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর। অনেক সময় বিনিয়োগকে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে ধরা হয়। বিনিয়োগ ব্যক্তি খাতে যেমন হতে পারে, তেমনি হয় রাষ্ট্রীয় খাতে। যে কোনো দেশে ব্যক্তি বা বেসরকারি বিনিয়োগ বড় একটা দিক।

বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ, বেসরকারি ব্যবসা-শিল্প বিশেষ অবদান রাখছে। সাম্প্রতিক বাস্তবতা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির চাপে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিক্রি হ্রাস, সুদের উচ্চ হার, শ্রম অসন্তোষ, পরিবহণ ও কারিগরি সমস্যা, ডলার সংকটে কাঁচামালের ঘাটতি, বৈশ্বিক যুদ্ধ ও আকস্মিক বন্যার বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করছে ব্যবসা-উদ্যোগ। পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কিছু কোম্পানির ব্যবসা করার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। ব্যবসার জন্য কিছু শর্তপূরণ প্রয়োজন।

প্রথমত, পরিবেশ লাগবে। ব্যবসার জন্য পরিবেশ দরকার। ব্যবসার আবহের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। সার্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং দেশের অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন- এটি বিবেচ্য বিষয়।

রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসাবাণিজ্যে স্থবিরতা, শিল্পে শ্রম অসন্তোষ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা, বিপুল খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজারে অস্থিরতার মতো পুরনো কিছু সংকট নতুন বছরেও অর্থনীতিকে ভোগাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে শিল্প খাতের সংকট হবে আরও প্রকট, চড়া মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ আরও কমবে, বাড়বে ঋণের সুদহার, বাধাগ্রস্ত হবে বিনিয়োগ, কমবে নতুন কর্মসংস্থানের গতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দু'তিন বছরে অর্থনীতি যে পরিমাণ অবনমিত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যতটা খারাপ অবস্থায় গেছে, সেটি টেনে তুলতে সময় লাগবে। অন্যদিকে, খেলাপি ঋণ ও পাচারের টাকা উদ্ধারে টার্গেট করা হয়েছে দেশের শীর্ষ ১০টি গ্রম্নপকে।

শিল্প বাঁচিয়ে টাকা আদায়ের কৌশল না নিয়ে বরং ত্বরিতগতিতে প্রবল চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০টি ব্যাংককে টেনে তোলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে অন্য সবল ব্যাংক থেকে সাময়িক ধারে অর্থ সহায়তা দেওয়া হলেও উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নিয়োজিত ১০টি গ্রম্নপকে টিকিয়ে রাখার বদলে বরং বন্ধের আয়োজন করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ১০ ব্যাংক ধ্বংস করার পর একই চক্রান্তে ১০ ব্যবসায়ী গ্রম্নপকে ধ্বংস করার নীলনক্‌শা চলছে। এরই মধ্যে দেশের রপ্তানিবাজার হুমকির মুখে পড়েছে। বিদেশি অর্ডার চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশে। চক্রটি এমন সুকৌশলে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, এতে দেশের বেসরকারি খাত ও শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। ক্রমেই ব্যবসা-বিনিয়োগ চলে যাবে ভিন্ন দেশে। আর মানুষ হারাবে কাজের সুযোগ। অর্থনীতি হবে নড়বড়ে।

দেশের অর্থনীতি নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। ছোট-বড় সব ব্যবসার ক্ষেত্রেই নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ সবকিছুই যেন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য সরাসরি সম্পৃক্ত। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, বিদ্যমান সব বাধা দূর করে ব্যবসার পরিবেশ নিরাপদ করা হবে।

ইতিহাসের বিচারে বাংলাদেশের অধিবাসীরা হার না মানা মনোভাবের অধিকারী। যুগের পর যুগ ধরে এ দেশের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করেছে। লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা। দুর্ভিক্ষে এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ আত্মোৎসর্গ করেছে, কিন্তু হার মানেনি। জুলাই'র গণ-অভ্যুত্থানে দেড় হাজার তরুণের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়কে সম্বল করে জাতি প্রবেশ করেছে নতুন বছরে।

\হস্বৈরাচার পতনের আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হয়েছে অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে। এ জন্য দেশের ব্যবসাবাণিজ্য ভয়াবহ ধকলের সম্মুখীন হয়েছে। দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারে গিয়ে ঠেকেছে। দেশজুড়ে চরম সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী চেতনা জয়ী হলেও সব ক্ষেত্রে বৈষম্য সীমাহীন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম নাজুক। নতুন বছরে এই সংকট আর দেখতে চায় না দেশের মানুষ। একটি বৈষম্যহীন, বিনিয়োগবান্ধব সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, এমন প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেছেন গোলটেবিলের বক্তারা। তাঁদের মতে, আমাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য- সব ক্ষেত্রে বৈষম্য সীমাহীন। উদ্বৃত্ত সম্পদের সুষম বণ্টনের দায়িত্ব সরকারের- যা সম্ভব হলে বৈষম্য হ্রাস পাবে। সংস্কার অবশ্যই দরকার। সংস্কারের জন্য দরকার জনগণের একাত্মতা। অন্যথায় সেই সংস্কার টেকসই হয় না- যা ভবিষ্যতে আরও বিপদ ডেকে আনে। সংস্কার এ সরকারকে শুরু করতে হবে, তবে তা যাতে নির্বাচিত সরকারের সময় পূর্ণতা পায়, তা নিশ্চিত করাও দরকার। দেশকে নিয়ে যেতে হবে নির্বাচনের দিকে। কারণ নির্বাচনেই কেবল গণপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে।

আশা করা যায়, দেড় দশকের গণতন্ত্রহীনতার গস্নানি শেষে নতুন বছরেই অনুষ্ঠিত হবে বহুল আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় নির্বাচন। আমরা এমন এক সময় নতুন বছরে পা দিচ্ছি, যখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। ইতিহাসের বিবেচনায় বাঙালি এক প্রাচীন জাতি। গাঙ্গেয় বদ্বীপের অধিবাসীদের রয়েছে ৫ হাজার বছরের ঐতিহ্য। আমাদের আধুনিক ইতিহাসও অহংকার করার মতো। প্রকৃতি উদারভাবে আমাদের দান করেছে উর্বর মাটি। এ মাটিতে বীজ বুনলেই সহজে ভরে যায় ফসলের মাঠ। এ দেশের নদনদী, খালবিল, হাওর-বাঁওড় যত্ন পেলে সোনার খনিতে রূপান্তরিত হয়। মানবসম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশকে দরিদ্র বলার অবকাশ নেই। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিকূল অবস্থাকে জয় করার সাহসও রাখে। প্রকৃতি আমাদের সেভাবেই সৃষ্টি করেছে। আমাদের রয়েছে পরিশ্রমী মানুষ। ঐক্যবদ্ধভাবে প্রয়াস চালালে সময়ের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জাতিকে সমৃদ্ধ বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু নয়। তবে এ জন্য দরকার জাতীয় ঐক্য। দরকার হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে শিরদাঁড়া সোজা করা। দরকার পারস্পরিক সহনশীল পরিবেশ। এ জন্য শুদ্ধ গণতান্ত্রিক চেতনায় আত্মস্থ হতে হবে। নতুন বছরে গণতন্ত্র চর্চা ও বহুমতের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে জাতিকে গড়ে তুলতে হবে সুদৃঢ় ঐক্য। গ্রেগরিয়ান নববর্ষে দেশ ও বিশ্ববাসীকে আমাদের শুভেচ্ছা। এ দেশের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও জনগণের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে যারা আত্মোৎসর্গ করেছেন, তাদের প্রতিও নববর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধা।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে