শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

ব্যাংকিং সেক্টরে সংকট উত্তরণ ও জনপ্রত্যাশা

ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যাংক জনগণের আস্থার জায়গা। জনগণের আমানত সংক্রান্ত সংকট উত্তরণে কার্যকরী ও কল্যাণমূলক এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যা জনমনে আশার আলো সঞ্চার করে এবং ব্যাংকের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ফিরে আসে।
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ব্যাংকিং সেক্টরে সংকট উত্তরণ ও জনপ্রত্যাশা
ব্যাংকিং সেক্টরে সংকট উত্তরণ ও জনপ্রত্যাশা

ব্যাংক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা অর্থ জমা-গ্রহণ, সংরক্ষণ ও ঋণ বা বিনিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন ছাড়াও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনেক কাজ করে। আধুনিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যাবলি সম্পাদন করে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় একটি চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত। সারাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এ সেক্টরকে ঘিরে চলমান। ব্যাংকিং খাতে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ঋণখেলাপি। ঋণখেলাপি সংস্কৃতি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম বাধা হিসেবে অভিহিত, যা অর্থনৈতিক কার্যধারাকে মূল্যহীন করে দেয়। ব্যাংকসমূহ ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমেই মূলত আয় করে থাকে। কিন্তু গ্রাহক যখন এই ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করে না, তখন তা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। এই অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় তো হয়ই না, অধিকন্তু মূল টাকাই গ্রাহকের হাতে আটকে থাকে। ফলে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর আয় কমে যায় এবং ব্যাংকগুলোতে সৃষ্টি হয় দায়বদ্ধতা।

খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর গতিকে পুরোপুরি আটকে রাখে। কারণ এই বিশাল পরিমাণ টাকা থেকে একদিকে ব্যাংক যেমন কোনো প্রকার আয় করতে পারে না, ঠিক তেমনি এই ঋণ অনাদায়ী হওয়ার কারণে তা নতুন করে অন্য কোনো সেক্টরে ঋণ সুবিধা বা বিনিয়োগ করতে পারে না। ফলে ব্যাংকের আয় কমে যায়, বিনিয়োগ কমে যায় এবং ব্যাংকের আর্থিক গতিশীলতাও কমে যায়। অপরদিকে এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে আয় থেকে প্রভিশন রাখতে হয় বিধায় ব্যাংকের আয়ের বিশাল একটি অংশ খেলাপি ঋণের ঘাটতি মেটাতে ব্যয় করতে হয়। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি ব্যাংকের আয়ের সমান হয় তাহলে আয়ের পুরোটাই প্রভিশন ঘাটতির পিছনে ব্যয় করতে হয়। এ অবস্থায় ব্যাংকের কোনো আয় অবশিষ্ট থাকে না। তাছাড়া জামানত অতি মূল্যায়ন, বন্ধকি সম্পত্তির দলিলপত্র সংগ্রহে দুর্বলতাও অনেক ক্ষেত্রে ঋণ আদায়ে সমস্যা সৃষ্টি করে।

তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যাংকিং খাতে বৈপস্নবিক পরিবর্তন এলেও এর দুর্বল দিকগুলো কাজে লাগিয়ে বড় ধরনের অঘটন ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনায় লোকসানের কারণে ঋণগ্রহীতা খেলাপি হতে পারেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছেন অনেকে। ঋণ খেলাপিরা ব্যাংক ও অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে রাতারাতি দামি দামি গাড়ি বাড়ির মালিক বুনে যায়। জনসাধারণের একটি বিশেষ অংশ বিভিন্নভাবে ঋণ গ্রহণ করে থাকে আবার স্বেচ্ছায় ও পরিকল্পিতভাবে ঋণ খেলাপিও হয়ে থাকে, যা একটি সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় আত্মপ্রকাশ পেয়েছে। মামলা করেও এ ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি ব্যাংকের আয়ের চেয়ে বেশি হয় তাহলে সেক্ষেত্রে ব্যাংক ক্ষতির অবস্থানে থাকে। ফলে ব্যাংকসমূহ আয় করেও তা ভোগ করতে পারে না। এ অবস্থায় ব্যাংকের অবস্থা দিন দিন নাজুক থেকে নাজুকতর হতে থাকে। খেলাপি ঋণের কারণে সরকারি কিংবা বেসরকারি ব্যাংক সমস্যার মধ্যে আটকা পড়ে। প্রতিটি ব্যাংকই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন আকারে সংরক্ষণ করে থাকে। এটা করা হয় বিদেশি ঋণদাতা এবং স্থানীয় আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। কোনো কারণে ব্যাংক যদি প্রদত্ত ঋণের কিস্তি আদায় করতে না পারে, তাহলেও যেন আমানতকারীদের অর্থ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধে অসুবিধা না হয় এবং ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনো ধরনের সংশয় সৃষ্টি না হয়, মূলত সে কারণেই ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ করে থাকে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন্য সংগৃহীত আমানত থেকে ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করে থাকে কিন্তু খেলাপি সংস্কৃতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংক খাতে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সংকট উত্তরণের জন্য ঋণ প্রদানের সময় অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান জামানত গ্রহণ করে থাকে, যাকে বন্ধক বলা হয়। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনে 'বন্ধক' বলতে ঋণ করার উদ্দেশ্যে স্থাবর সম্পত্তির স্বত্ব হস্তান্তরকরণকে বুঝায়। এটা কর্জ নিবারণের জন্য একটি ব্যবস্থা। বন্ধকদাতা এই মর্মে সম্পত্তি বন্ধক রাখেন যে, ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধার টাকা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা হলে বন্ধকগ্রহীতা অতঃপর দাতার রক্ষিত সম্পত্তিটি দাতার বরাবরে ফেরত দিতে বাধ্য। ঋণ কিংবা বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হয়। ঋণ প্রদানের পূর্বে প্রথমে তারল্য সংকটের বিষয়টি। তারল্য সংকটে পড়তে হবে কিনা। বিনিয়োগকৃত বা ঋণের টাকা কতো সময়ে উঠে আসবে তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানত পর্যাপ্ত কিনা বিবেচনা করে দেখতে হবে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জামানতের সম্পত্তি বা বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রয় করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণের প্রদত্ত অর্থ ফিরে পাবে কিনা। মুনাফার সম্ভাবনার, ঋণ বা বিনিয়োগ খাতটি কতটুকু লাভজনক তা বিবেচনা করতে হবে। ঋণ প্রদানের পূর্বে ঋণগ্রহীতার পূর্বের রেকর্ড অর্থাৎ সামাজিক সুনাম, পুলিশ রেকর্ড বা ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা তা যাচাই করতে হবে। অতীতের রেকর্ড খারাপ থাকলে ঋণ প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থা, ব্যবসায়িক দক্ষতা দেখা জরুরি। এমন খাতে ঋণ প্রদান করতে হবে, যা প্রদান করা হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দরিদ্র, মূলধন, সামর্থ্য, নির্ভরশীলতা, দায়িত্বশীলতা এবং সম্পদশীলতা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান করা যাবে না। ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। ব্যাংক কর্তৃক অলিখিত চার্জ ডকুমেন্টে ঋণগ্রহীতা ও জামিনদারের স্বাক্ষর গ্রহণের দীর্ঘ দিনের বেড প্র্যাকটিস বন্ধ করতে হবে। চার্জ ডকুমেন্ট এক বসায় এক হাতে এক কলমে পূরণ করতে হবে। ঋণ মঞ্জুরের পূর্বে অবশ্যই ঋণগ্রহীতা বা গ্যারান্টি দাতার পূর্ণ ও সঠিক বিবরণ যাচাই করা। ঋণগ্রহীতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ ঠিকানা, মালিকানার কাগজপত্র, হিসাব বিবরণী, তার বর্তমান সম্পদ ও দায়দেনা, তার বাজারের সুনাম, অন্য ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন পরিস্থিতির ওপর পূর্ণ আলোচনা যাচাই, ট্রেড লাইসেন্স, অন্য লাইসেন্সাদি, ইনকাম ট্যাক্স সংক্রান্ত কাগজপত্র, ছবি, পাসপোর্ট ইত্যাদি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে।

বর্তমানে দেশের প্রচলিত ঋণ খেলাপি কালচার থেকে পরিত্রাণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এসব ব্যাপার অবশ্যই ত্রম্নটিমুক্ত হতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হলো নিরাপদ জমানত গ্রহণ। অন্যান্য উন্নত দেশের ঋণ মঞ্জুরি বিবেচিত হয় প্রকল্প বা উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে। আমাদের দেশে এটা হয় জামানতের ভিত্তিতে। যে উদ্দেশ্যে (পণ্য বা শিল্প প্রকল্পে) ঋণদান করা হয় সেটাই প্রাথমিক ও মুখ্য জামানত। আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে আরও একটি অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে, অতিরিক্ত জামানত গ্রহণ করা, যা সাধারণত বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি, বিভিন্ন স্থাবর সম্পত্তি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে হয়। এ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ থেকে যায়। ব্যাংকিং খাত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমানতকারী তথা সাধারণ জনগণের অর্থ দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি ঋণের মাধ্যমে আত্মসাৎ হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন সংক্রান্তে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩-এর গেজেট প্রকাশ করা হয়। এ আইনে বলা হয়, কেউ খেলাপি হলে অন্য কোনো ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিতে পারবে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ খেলাপি হলে তিনি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে। ঋণের অর্থ পরিশোধ করলেও তিনি পরবর্তী পাঁচ বছর আর পরিচালক হতে পারবেন না। ঋণখেলাপিরা দেশের বাইরে যেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। এ আইনে 'ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা'র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যিনি নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে, নামে-বেনামে বা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করবেন না, তাকেই বলা হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে অধিকার ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে 'ব্যাংক' শব্দ ব্যবহারের অপরাধে সর্বোচ্চ সাত বছর বা ৫০ লাখ টাকা দন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এমন বিধানও অন্তর্ভুক্ত আছে। আইনে আরও বলা হয়, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক এরূপ বিবেচনা করে যে, কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান জ্ঞাতসারে বা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিধান লঙ্ঘন করছে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানকে নূ্যনতম ৫০ লাখ টাকা বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ বিধান লঙ্ঘন চলমান থাকলে প্রথম দিনের পর প্রতিদিন এক লক্ষ টাকা হারে জরিমানা প্রদান করতে হবে।

ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশ প্রাপ্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং রাখার বিধান প্রণয়ন করতে হবে। বারবার পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি করতে হবে। প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ করতে হবে। পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সীমিত হলেও পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে। খেলাপি ঋণসহ ব্যাংকিং খাতে সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ঋণ খেলাপিরা যাতে প্রতারণা ও আইনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে আইনে সে ব্যবস্থার পাশাপাশি ঋণ বা বিনিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকেও স্বচ্ছতার এবং জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। জনগণের অর্থ লুণ্ঠনের যুগে যুগে চলে আসা ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে রুখতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাপক বাধাগ্রস্ত হবে। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ ও অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ কে আরও গতিশীল ও যুগোপযোগী করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সমস্যা সমাধানে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারসহ পর্যবেক্ষক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকৃত সৎ, পরিশ্রমী, মেধাবী ও যোগ্য ব্যবসায়ী/শিল্পপতিদের প্রয়োজনীয় ঋণ/বিনিয়োগ সুবিধাসহ প্রণোদনা ও উৎসাহ প্রদান করতে হবে। ঋণ গ্রহণের উদেশ্যে প্রস্তাবকৃত জামানত বা সম্পত্তির প্রকৃতি যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সম্পত্তি কারো নিকট দায়বদ্ধ আছে কিনা বা পূর্বে কোথাও বন্ধক প্রদান করেছে কিনা তা সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের মাধ্যমে যাচাই করা জরুরি। উক্ত সম্পত্তি সংক্রন্তে আর, এস রেকর্ডীয় মালিক হতে স্বত্বের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দেখতে হবে। স্বত্বের ধারাবাহিকতার সংশ্লিষ্ট সব বায়া দলিল, আর, এস খতিয়ান, বি,এস খতিয়ান, দায়মুক্ত সনদ, বি,এস নামজারি খতিয়ান, ডিসিআর, হালসন খাজনা পরিশোধের দাখিলা, সিডিএ/রাজউক অনুমোদনপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), হাউজিং সোসাইটির পস্নটের ক্ষেত্রে এনওসি বা অনুমতিপত্র, সার্ভে রিপোট বা আর, এস দাগের সঙ্গে বি,এস দাগ মিলামিল সংক্রান্ত সংবাদের দরখাস্ত ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট খতিয়ান সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট এ.সি (ল্যান্ড)/সংশ্লিষ্ট কালেক্টরেটের রেকর্ডরুমে তলস্নাশিক্রমে সঠিক আছে কিনা যাচাই করে দেখতে হবে। জমির স্কেচ ও চৌহদ্দি নির্ধারণসহ তফসিলভুক্ত সম্পত্তিতে মালিকের সরেজমিন পৃথক চিহ্নিত মতে বাস্তব দখল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। ঋণ খেলাপি হওয়ার বিশেষ কারণ হচ্ছে ঋণগ্রহীতা নির্বাচনে দুর্বলতা, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের অপর্যাপ্ততা, অতিমূল্যায়ন ও ঝুঁকি বিশ্লেষণে দুর্বলতা, সঠিক কাঠামো মেনে ঋণ প্রদানে অক্ষমতা, এক ব্যাংক কর্তৃক অন্য ব্যাংকের খারাপ ঋণ অধিগ্রহণ, চলতি মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ না করা, একাধিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান, শাখা পর্যায়ে ঋণ প্রদানের ক্ষমতা সীমিতকরণ, ঋণ পুনঃতফসিলকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহার।

ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যাংক জনগণের আস্থার জায়গা। জনগণের আমানত সংক্রান্ত সংকট উত্তরণে কার্যকরী ও কল্যাণমূলক এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যা জনমনে আশার আলো সঞ্চার করে এবং ব্যাংকের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ফিরে আসে। আমানতকারীদের আমানত ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা যেন হুমকির মুখে না পড়ে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিশেষে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিমুক্ত করতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দেশের অর্থনৈকিত উন্নয়নের স্বার্থে ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা কাটাতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ জোরদার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। ভদ্রবেশী ঋণ খেলাপিদের হাতে যাতে দরিদ্র জনগণের অর্থ না যায় তার জন্য সচেতন থাকতে হবে। সঠিক বিনিয়োগ বাড়াতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ : আইনবিদ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে