তিরিশ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানির ইতিহাস এবং বহু বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এক রক্তক্ষয়ী, জ্বালাময়ী ঘটনা পরম্পরা- যা বাঙালি জাতিকে শিহরিত করে। একাত্তরে শুধু নিষ্ঠুর পাক হানাদার বাহিনী একাই এমন মরণ কামড়ে শামিল হয়নি, সঙ্গে ছিল এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর আর আলশামসের মতো এক বিধ্বংসীগোষ্ঠীর নারকীয় কর্মকান্ডও। স্বাধীনতার দীর্ঘ একুশ বছর পর জনতার রায়ে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমেই জাতির পিতার হত্যার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যারা গভীর ষড়যন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে মানুষ হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের মতো ঘোরতর অন্যায়ের অংশীদার হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধেও আইনি প্রক্রিয়াকে জোরদার করেন। বিচারিক ব্যবস্থায় তাদের পাপের দন্ডও কার্যকর করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন করে আবারও স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকা সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করায় মুক্তির চেতনায় আপামর জনগোষ্ঠী আবারও নতুন উদ্যমে জেগে উঠেছে। অপরদিকে সরকারের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বলাই বাহুল্য, মাত্র সাড়ে ৩ বছরের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এই কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আসার আগেই আরও এক নৃশংস হত্যাকান্ড সারা বাংলাকে হতবাক করে দেয়। জাতির জনকের অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যা নকশায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি নতুন করে নিজেদের আধিপত্য সংহত করলে পরবর্তী একুশ বছর দুঃসহ অভিযাত্রায় বাংলাদেশ এক চরম অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়। এমন কঠিন আর দুর্ভেদ্য পথপরিক্রমায় কিভাবে যে উজ্জীবনের শক্তি উদ্ভাসিত হয়, সেও যেন বঙ্গবন্ধু কন্যার অকৃত্রিম দুঃসাহস আর অনমনীয় দেশাত্মবোধের অনির্বাণ দীপ্তি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী আলবদর, আলশামসের ঔদ্ধত্য আর চরম খামখেয়ালিপনাকে যথার্থভাবে প্রতিকার করতে শেখ হাসিনাকে ২০০৮ সালে আবারও জনগণের রায়ে অভিষিক্ত হয়ে দেশনায়কের আসনে বসতে হয়। বীরদর্পে এগিয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা পিতার আদর্শকেই শুধু লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় আনেননি, বিবেচনায় এনেছেন এ দেশ থেকে অপশক্তি নির্মূলে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার প্রথম ধাপে প্রকাশিত হলে রাজাকারের তালিকা।
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, এই তালিকা প্রকাশকালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে স্পষ্টভাবে উলেস্নখ করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে স্থানীয় ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা রাজাকারদের তালিকা সংরক্ষণের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি সরকারের বেতনভাতা ভোগ করে দেশের জনগণের ওপর নির্বিচারে হত্যা, জুলুম আর নির্যাতন চালায়, তাদের চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করা দেশের স্বার্থেই অত্যন্ত জরুরি। উলেস্নখ করা যেতে পারে, ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর আসন অবৈধ ও দেশদ্রোহী হিসেবে আমলে নিয়ে যারা ওই শূন্যপদে বসেছিল তাদের নামও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে গণ্য হবে। সেই সব শূন্য আসনের সদস্যদের তালিকা সংরক্ষণেরও সুপারিশ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। তেমন সব নির্দেশনা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হচ্ছে।
সর্বোপরি বলা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এমন মহৎ কর্মপ্রকল্প দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে আরও এক নতুন মাত্রা যোগ করল। জনস্বার্থ আর দেশের কল্যাণে প্রণীত এমন কর্মপরিকল্পনা যেন তার লক্ষ্যমাত্রায় এগিয়ে সার্বিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে পারে সে প্রত্যাশা আমাদের। পাশাপাশি তালিকায় ঠাঁই পাওয়া রাজাকারদের যথাযথ শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশবাসীর এমনটিই প্রত্যাশা।