শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ছায়াযুদ্ধ থেকে প্রকাশ্য যুদ্ধ-সংঘাতের নতুন অধ্যায়ে মধ্যপ্রাচ্য

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা উত্তেজনা গত বছরের শেষ কয়েক দিনে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সরাসরি কোনো যুদ্ধ না থাকলেও দুই দেশের মধ্যে রয়েছে একাধিক ফ্রন্টে ছায়াযুদ্ধ। এ পরিস্থিতিতে কাসেম সোলাইমানির হত্যা বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় একটি ঘটনা।
মাছুম বিলস্নাহ
  ০৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুলস্নাহ আলি খামেনির পর দ্বিতীয় সোলাইমানি ক্ষমতাধর ব্যক্তি কাসেম সোলাইমানিকে নতুন বছরের ৩ জানুয়ারি সকালবেলা ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। তার সঙ্গে ইরাকি মিলিশিয়া নেতা আবু মাহদি আল মুহান্দিসকেও হত্যা করা হয়। প্রেন্টাগন থেকে বলা হয়, ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে এই হত্যাকান্ড চালানো হয় যাতে মার্কিনীরা সর্বত্র নিরাপদে থাকতে পারে। এটি একটি হাস্যকর যুক্তি। এটি বরং ট্রাম্পের ঝোঁকনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি ও বেপরোয় আচরণের আরেকটি উদাহরণ। এর ফলে, গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে কঠিন সংঘাতের মুখে ঠেলে দেয়া হলো সে বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প চিন্তা করেনি। এই হামলার মাধ্যমে যে অধ্যায়ের সূচনা হলো সে পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ধ্বংসাত্মক হতে পারে কারণ তেহরান কঠিন প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যদিও বিষয়টিতে উলস্নাস প্রকাশ করেছে ইসরাইল, সৌদি আরব আর জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। এটি নিশ্চিত, সোলাইমানির হত্যাকান্ডে আক্রান্ত হবে কমবেশি মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ। পুরো অঞ্চলে শুরু হতে পারে ছদ্মযুদ্ধের নতুন অধ্যায়। তার মৃতু্যর খবর প্রকাশ হওয়া মাত্র বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে। ইউরোপ থেকে হংকং, প্রধান প্রধান পুঁজিবাজারের সূচক পড়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়ে উঠতে পারে। ইরাকে ইরানসমর্থিত সব মিলিশিয়াগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে তাদের কমান্ডারের মৃতু্যর প্রতিশোধ নিতে। তেহরান খুব ধীরে পদক্ষেপ নিতে পারে। দেশটির সামরিক-বেসামরিক নেতারা সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, পৃথিবীর অন্য জায়গাতেও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ফ্রন্ট খুলতে পারে ইরান। অফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা হতে পারে সেই নতুন ফ্রন্ট। আমেরিকনরা যে কোথাও নিরাপদ নয় সে ধরনের একটি বার্তা দিতে চাইবে তেহরান, তাতে সন্দেহ নেই। সিরিয়া ও ইরাকে আইএসবিরোধী যুদ্ধে সোলাইমানির সঙ্গে অলিখিত চুক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের। তাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী একে অন্যের বিরুদ্ধে তাই যুদ্ধে জড়াতো না। তবে আইএসের পতন এবং ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলে পরিস্থিতি বদলে যায়। দীর্ঘদিন ধরে সোলাইমানি সিআইএ এবং মোসাদের হিট লিস্টের প্রথমদিকে ছিলেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ইরানের কুদস ফোর্সের নেতৃত্ব দেয়া সোলাইমানি ইরানের শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে দেয়া হতো জাতীয় বীরের সম্মান। তার কুদস বাহিনী সরাসরি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা খামেনির কাছে জবাবদিহিতা করে। সিরিয়া অথবা লেবানন থেকে সোলেইমানি বাগদদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তিনি মুহানদিসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তাদের বহনকারী গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডস জেনারেল সোলেইমানির মৃতু্যর খবর নিশ্চিত করে এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কানি কুদস ফোর্সের নতুন প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন।

ফ্লোরিডার একটি রিসোর্টে ছুটি কাটানো অবস্থায় ট্রাম্প সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্তের কথা জানান। কংগ্রেসকে এ ব্যাপারে কিছু জানাননি তিনি। তবে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিততে এ ধরনের বড় কোনো পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল ট্রাম্পের। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যেমন তার প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগে আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যে লেবাননের হিজবুলস্নাহ অভিযান ও প্যালেস্টানিয়ান ইসলামী জিহাদের মতো যুক্তরাষ্ট্রের চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন করে ইরানের প্রাথমিক অস্ত্র কুদস ফোর্স। এসব সংগঠনকে তারা অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। বিবিসি বলছে, ইরানের এই কমান্ডারের হাতে বহু মার্কিনের রক্ত লেগে আছে। এটি যদি প্রকাশ্য প্রধান কারণ হয়, তো অপ্রকাশ্য প্রধান কারণটি হচ্ছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুসৃত ও সর্বোচ্চ চাপনীতির বিপরীতে ইরানের যে প্রতিরোধযুদ্ধ তার মূল নেতৃত্বে ছিলেন সোলাইমানি। তাই মার্কিন বাহিনীর এমন এক হামলায় সোলাইমানি নিহত হবেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কয়েক বছর ধরে লেবানন, সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইরানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন বস্নকের যে যুদ্ধ চলছে, তার পেছনের কারিগর এই বিশেষ বাহিনী। সোলাইমানির রণকৌশল অনুসরণ করেই ইয়েমেনে হুতিরা যুদ্ধে লিপ্তের সঙ্গে যখন গত বছরের শেষে ইরাকে মার্কিন বাহিনী ও ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের সুরক্ষাও প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সোলাইমানিকে আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। গত বছরের শেষ কয়েক মাসে মার্কিনি নিষেধাজ্ঞায় থাকা ইরান বিভিন্ন ফ্রন্টে চলা ছায়াযুদ্ধে নিজেদের শক্তির জানান দেয়। এর মধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জ্বালানি তেলবাহি জাহাজ ও স্থাপনায় বোমা হামলা উলেস্নখযোগ্য। সরসারি মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনাও ঘটে এই সময়ে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছিল। ছোট ও মাঝারি মানের এসব হামলার সংখ্যা ক্রমে বাড়ছিল। এতে মার্কিন বেসমারিক এক ঠিকাদার নিহত হন, এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানসমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর ওপর হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষক এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা ড্যানিয়েল ডেভিস বলেছেন, 'শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি যদি যুদ্ধের দিক আগায়, তাহলে ওয়াশিংটনের কোনো লাভ হবে না। তবে এই যুদ্ধ হবে প্রত্যেকের জন্য বিপর্যয়কর। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে তারা সোলেইমানিকে হত্যার উদ্দেশ্যে মার্কিন অভিযানকে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ হিসেবে মনে করে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবসময়ই জোর প্রয়োগের বিরোধী চীন। তিনি বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পক্ষ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে শান্ত থাকতে ও সংযম অনুসরণ করতে বলব। আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোলেইমানিকে হত্যার জন্য ট্রাম্পের প্রশংসা করেন। ডেমোক্র্যাট দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হামলা ও ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেছেন, 'মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের একটি সংঘাতের মুখে পড়তে পারে ওয়াশিংটন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক পরিচালক জেমস ক্ল্যাপার বলেন, এ অঞ্চলে থাকা আমেরিকানরা হুমকির মুখে পড়বে।' এটি স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় অথচ ট্রাম্প বলছেন, মার্কিনিদের নিরাপদ রাখতেই সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার ফলে প্রক্সি যুদ্ধ এখন প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। আর এই যুদ্ধক্ষেত্র হতে পারে ইরাক। ইরানের জন্য এটি বড় সংকট হলেও ইরানের বর্তমান নেতৃত্বকে অভ্যন্তরীণ সংকটে লাভবান করতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিক্ষোভের মতো অভ্যন্তরীণ সমস্যায় পড়া ইরান সরকার তার পক্ষে এখন জনসমর্থন দেখাতে পারবে।

প্রশ্ন হচ্ছে- ইরান কি এখনই সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে? সরাসরি না জড়ালেও ইরাকসহ বিভিন্ন ফ্রন্টে মার্কিন বস্নকের সঙ্গে যুদ্ধে আরও মনোযোগী হবে। মার্কিন বাহিনীর জন্য ইরাক অনেক কঠিন ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসতে হতে পারে। তবে এটি সত্য, এই দুই দেশের লড়াইয়ের বড় শিকার হবে বৈশ্বিক অর্থনীতি। জ্বালানি তেল সরবরাহের একটি বড় অংশ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে, যার নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই ইরানের হাতে। ইরান এই রুট বন্ধ করে দিলে বড় ধরনের বিপাকে পড়বে গোটা বিশ্ব। কারণ গোটা বিশ্বের মোট গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ ও জ্বালানি তেল সরবরাহের এক-চতুর্থাংশই হয় এ পথ দিয়ে। ফলে জ্বালানি তেলের দামে সরাসরি প্রভাব পড়বে, যা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসী আঁচ করতে শুরু করেছে। যুদ্ধ যে কোনো কিছুর সমাধান নয়, বরং কারুর প্রতিশোধ স্পৃহা পূরণ করার সাময়িক এক ধ্বংসাত্মক অবস্থা। এই পন্থা বিশ্বের কোটি কোটি নিরীহ মানুষকে অযথা অসহ্য যন্ত্রণা দেয় যা থেকে বিশ্ববাসী মুক্তি চায়।

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা উত্তেজনা গত বছরের শেষ কয়েক দিনে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সরাসরি কোনো যুদ্ধ না থাকলেও দুই দেশের মধ্যে রয়েছে একাধিক ফ্রন্টে ছায়াযুদ্ধ। এ পরিস্থিতিতে কাসেম সোলাইমানির হত্যা বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় একটি ঘটনা।

\হকথা হচ্ছে, সোলাইমানিকে হত্যার উদ্দেশ্যে এমন হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে কেন এ সময়টিকে বেছে নিল, যেখানে আগে অন্তত দুবার তাকে নাগালে পেয়েও ছাড় দিয়েছিল মার্কিন বাহিনী। তার উত্তর ঐটিই যে, নির্বাচনে জেতার জন্য বৈশ্বিকমন্ডলে ট্রাম্পের একটি অর্জন(?) দরকার ছিল। ২১-২২ বছর হলো কুদস বাহিনী গড়ে তুলেছেন সোলাইমানি। অপ্রচলিত যুদ্ধের জন্য তৈরি একটি বৃহৎ স্পেশাল অপারেশন ইউনিট, যার প্রধান কর্মক্ষেত্র এখন ইরানের বাইরে। এই বাহিনী ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে ইতোমধ্যে সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তন এনেছেন কাসেম। যে তৎপরতার হাওয়া লেগেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে অর্থনীতিতে। সোলাইমানির কাজ বহু বিশ্বশক্তির স্বার্থে আঘাত দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে প্রবেশ করছে যুক্তরাষ্ট্র আর ট্রাম্প অভিশংসরনের মতো এক অস্বস্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তার তেমন কোনো অর্জন নেই। তাই নির্বাচনের আগে তার অন্তত একটি বিজয় প্রয়োজন, আর সে জন্যই তিনি এই অর্জনকে বেছে নেন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ইরান আর তার প্রতিপক্ষ মুসলিম রাষ্ট্র সৌদি আরব যখন ইরানেরই শত্রম্ন তখন এই সহজ কাজটি করে তার অর্জনের পালস্না ভারী কেন করবেন না?

মাছুম বিলস্নাহ: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<83071 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1