রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইউটিউবকে টার্গেট করে নির্মিত হচ্ছে নাটক

বিনোদন রিপোর্ট
  ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
'বেশরম' নাটকের একটি দৃশ্য

নেট দুনিয়ার অবাধ প্রবহমানতায় গা ভাসিয়ে ইউটিউবের পাশাপাশি ব্যক্তি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পেজের জন্য নির্মাণ হচ্ছে হাজার হাজার কন্টেন্ট। এই কন্টেন্টগুলোর মানদন্ড নিয়ে অনেক দিন ধরেই জোর সমালোচনা হচ্ছে। তথাকথিত জনপ্রিয়তার নামে ভিউ বা ফলোয়ারের ওপর মান বিচারের কারণে অনেকেই স্বঘোষিত তারকা বনে যাচ্ছেন। টিভি নাটকের শিল্পীরা পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে ভালো নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্পী সংকটে ভুগছেন নির্মাতারা। কিছু শিল্পীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে টিভি নাটকের কনটেন্ট। তথাকথিত ভিউ বাণিজ্যের কবলে পড়ে টিভি নাটকের মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এই অবস্থার রেশ টেনে না ধরা গেলে অচিরেই এই শিল্প ধ্বংসের অনিবার্যতা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ভিউ নাটকের মানদন্ড নির্ধারণ করে না। তাছাড়া এটা কোনো নাটকের মানদন্ড হতেও পারে না। কিন্তু শিল্পীরা এই সুযোগে তারকা খ্যাতির অজুহাতে নিজেদের চড়া মূল্যে ভাগ বসাচ্ছেন। কিন্তু ভিউ হলেই যে কাজটি মানসম্মত বা ভিউগুলো আসল সেটাও বলা যাবে না। কারণ অনেক খারাপ কাজেরও ভিউ হয়, আবার বুস্ট করেও ভিউ বাড়ানো যায়। অন্যদিকে ভালো কাজের ভিউ অনেক কম হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই ভিউয়ের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে আসছেন সিনিয়র অভিনয় শিল্পীরা। কেউ কেউ আবার এই জোয়ারকে স্বাগত জানিয়ে নীরব ভূমিকাও পালন করছেন।

এ প্রসঙ্গে দেশের বরেণ্য অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, ভিউ বা ফলোয়ার দিয়ে অভিনেতার জন্ম হয় না। ফেসবুক ফলোয়ার দিয়ে শিল্পী হবে না, ইউটিউব কন্টেন্ট দিয়ে অভিনেতার জন্ম হয় না। এই রকম চলতে থাকলে এক সময় ভয়ানকভাবে ঝড়ে যাবে। রাজ্জাক-শাবানাদের উদাহরণ টেনে এই অভিনেত্রী বলেন, একজন রাজ্জাক সাহেব, আলমগীর, আসাদুজ্জামান নূর, হূমায়ন ফরিদী বা আমার তো কোনো ফলোয়ার নেই। ফলোয়ারের ওপর ভিত্তি করে এসব নাম হয়নি বাংলাদেশে। একজন শাবানা আপা কিংবা একজন ববিতা, মৌসুমী, শাবনূর পর্যন্ত- এদের দেখে জানা প্রয়োজন ফলোয়ার দিয়ে শিল্পী তৈরি হয় না বলে মন্তব্য করেন সুবর্ণা মুস্তাফা। তবে তিনি বলেন, তরুণ নির্মাতাদের প্রতি আমার আস্থা আছে। নির্মাতা হিসেবে অনেকেরই নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। তাদের কাজ দেখার অপেক্ষায় আছি। আশা করছি, দর্শকরাও ভালো কাজের পাশে থাকবেন। তিনি বলেন, দর্শকরা ভালো নাটক বা চলচ্চিত্র শিল্পকে ভালো বাসবেন। চলচ্চিত্র প্রযোজকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ভালো চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করবেন। এটা খুব প্রয়োজন। তাহলেই নান্দনিক ও ভালো নাটক, সিনেমা আসবে।

নির্মাতা আশফাক নিপুণের মতে, কোনো কাজে যদি মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়, তবে ধরে নেওয়া হয় কাজটা খারাপ। কোটি ভিউ হলেই যেমন সব কাজ মানোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ হয়ে যায় না, তেমনি কোটি ভিউকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ারও কিছু নেই। প্রতিটা কাজের আলাদা দর্শক শ্রেণি থাকে, কিছু কাজ তৈরি হয় সব শ্রেণির দর্শককে তুষ্ট করার কথা মাথায় রেখে সহজ ভঙ্গিতে, সেগুলোর কিছু কোটি ভিউ পার করে, সাধারণত রোমান্টিক আর কমেডি ধাঁচের কাজ হয় সেগুলো। এখন কালোত্তীর্ণ হবে কিনা সেটা সময় বলে দেবে কিন্তু সাময়িকভাবে সেই কাজ এত সংখ্যক দর্শককে আকৃষ্ট করতে পেরেছে সেটা যে কারণেই হোক, এটাকে ফেলনাভাবে উপস্থাপন করার কিছু নেই।

সম্প্রতি 'পাপ ড্যাডি' নামক একটি কন্টেন্ট এর উপস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এর কন্টেন্ট এবং অভিনয় শিল্পীদের এ বিষয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা কতটা রক্ষিত হয়েছে এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও হয়েছে। এই কন্টেন্টের বিষয়ে তেমন কেউ মুখ না খুললেও অভিনয় শিল্পী আজাদ আবুল কালাম পাভেল বলেন, যে কোনো কাজের আলোচনা-সমালোচনা হবেই। তবে কিছু বাস্তব জিনিস আছে যা সমসাময়িক চাহিদায় আমাদের দর্শক দেখার জন্য প্রস্তুত। আমি আমার কাজটা ঠিকঠাক মতো করি। 'পাপ ড্যাডি' সিনেমার আমি আমার অংশটুকু যতটা সম্ভব যথষ্ট সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। সুতরাং এ নিয়ে আমার ভাবনার কিছু নেই। আমি এ নিয়ে মাথা ঘামাইনা।

সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো যে বেশির ভাগ টিভি চ্যানেলেই এখন ইউটিউবকে টার্গেট করে নাটক নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে ভিউ চিন্তা করে শিল্পী নির্বাচন থেকে শুরু করে গল্প, সংলাপ সব কিছুকে নির্ধারণ করা হয় ইউটিউবকে সামনে রেখে। সেক্ষেত্রে নাটকের নাম এবং সংলাপে নানা অস্বস্তিকর বিষয় চলে আসে। কিছু কিছু ইউটিউব তারকা এবং নির্মাতা যাঁরা অশ্লীলতার কারণে একসময় টিভি চ্যানেলে ততটা জনপ্রিয় ছিলেন না, তারা ইউটিউবের জন্য নির্মিত এসব নাটকের উদ্ভট গল্প, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অশ্রাব্য গালি প্রয়োগের মাধ্যমে নিম্নরুচির একশ্রেণির দর্শকের কাছে বেশ পরিচিত হয়ে উঠছেন। এই দর্শকদের বয়সসীমা ১৫ থেকে ২৫ এর মধ্যে। তবে এই বয়সের আর একশ্রেণির দর্শক রয়েছে যারা এসব দেখে না, বরং সুস্থ নাটক, অনুষ্ঠান কিংবা বিভিন্ন ওটিটি পস্ন্যাটফর্মে বিদেশি ভালো ভালো মুভি কিংবা নেট দুনিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদ, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীনের মতো নাট্যকাররা নাটক করেছেন। তখন হয়তো 'ভিউ'য়ের প্রচলন ছিল না কিন্তু দর্শকরা নাটক দেখতে গিয়ে টিভি পর্দা থেকে চোখ ফেরাতে পারত না। অনেকের মতে দিন ও সময় পাল্টেছে। কিন্তু সেই তুলনায় মারাত্মকভাবে রুচির বিপর্যয় ঘটেছে। যা শুধু দর্শক রুচিকেই নষ্ট করছে না, আমাদের সংস্কৃতিকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় কিছু কিছু নাটক গল্পবিহীন সম্পূর্ণ নাটকটি ভাঁড়ামিপূর্ণ। অতি অভিনয়, চিৎকার, কান্নাকাটি, নায়িকা এসে বাবাকে ধমকানো, নিম্নমানের ফটোগ্রাফি-সব কিছু মিলিয়ে ভিউ বাড়ানোর তাগাদায় নাটকটিতে শেষে একটি বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু এ ধরনের অযৌক্তিক ও অবাস্তব চরিত্রের মুখে কোনো বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে না। এসব নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে প্রাইভেট ইউটিউব চ্যানেলেগুলোর জন্য কোনো নিয়ম, শর্ত বা কোনো ধরাবাঁধা নির্দেশনা না থাকায় যে যার যাচ্ছে তাই কন্টেন্ট বানিয়ে নাটক বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এসবই ভিউ বাণিজ্যের আড়ালে মিডিয়ার স্বাধীনতা মানে সমাজবিরুদ্ধ, দেশবিরুদ্ধ ও সংস্কৃতির পরিপন্থি অনুষ্ঠান নির্মাণ কখনই কাম্য নয়। দর্শকদেরও এ ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন মনে করে সংশ্লিষ্টরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে