বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পী সমিতি আমার খোঁজ নেয় না :প্রবীর মিত্র

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শিল্পী সমিতি আমার খোঁজ নেয় না :প্রবীর মিত্র

শুধু বাংলাদেশের সিনেমাতেই না, কলকাতা ইন্ডাস্ট্রিসহ দুই বাংলা মিলিয়েও যদি গত কয়েক দশকের সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিনেতার কথা বলতে হয় নিঃসন্দেহে সেখানে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কারপ্রাপ্ত প্রবীর মিত্রের নামও থাকবে। একজন অকৃত্রিম দিলখোলা অভিনয়ের মানুষ তিনি- হাসলে যার গালে মৃদু টোল পড়ে। অভিনয়ের শুরুতে ছিলেন তিনি নায়ক চরিত্রের অভিনেতা। পরবর্তীতে পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা হিসেবে প্রায় একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন। নায়ক হিসেবে যেমন পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা হিসেবেও সমান সফল এ অভিনেতা দর্শকের মণিকোঠায় যতটা জুড়ে আছেন, সেটা ঢাকাই সিনেমাতেই প্রায় বিরল। অনেকে আছেন নায়ক হিসেবে সফল হলেও অভিনয়ের মূল জায়গায় চরিত্রাভিনেতা হিসেবে সফল হতে পারেননি। সেখানে প্রবীর মিত্র এই ব্যতিক্রমদের অন্যতম।

দিলখোলা মনের এই প্রবীর মিত্র মনমরা হয়ে পড়ে আছেন বেশ কয় বছর। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না বলে তাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে এমন গুজবও রটে 'প্রবীর মিত্র আর নেই'।

এই গুজব বারবার মিথ্যা প্রমাণিত হলেও প্রবীর মিত্র যে অনেকটা থেকেও না থাকার মতো জীবনযাপন করছেন- এটা অনেকেই মনে করেন। হয়তো প্রবীর মিত্র নিজেও বোঝেন। তাই তো অভিনয় পাগল এই মানুষটি এখনো অভিনয় করতে চান। এ নিয়ে তিনি বলেন, 'আমি তো চাইলে ঘরে বসেও অভিনয়টা চালিয়ে যেতে পারি। নির্মাতারা চাইলে সেরকম চরিত্র তৈরি করতে পারেন।'

অভিনয়ের প্রতি প্রবীর মিত্রের এই যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও ক্ষুধা- এটা বুঝলে কিন্তু নির্মাতারা তেমন চরিত্র তৈরি করে তাকে দিয়ে অভিনয় করাতেন! এটা বিশ্বের অন্য বড় ইন্ডাস্ট্রিতে হলে সম্ভব হতো। ষাট-সত্তর দশকে হলেও সম্ভব হতো। প্রবীর মিত্রের মতো বার্ধক্যে না পড়লেও পা কাটা গিয়ে পঙ্গু রহমানকে দিয়ে কিন্তু কিছু সিনেমায় অভিনয় করানো হয়েছিল।

প্রবীর মিত্রের এই বাসনাটি হয়তো আদৌ পূরণ হচ্ছে না সেটা এখনকার নির্মাতাদের সাংঘাতিক রকমের সীমাবদ্ধতা দেখেও বোঝা যায়। ৮২ বছরের এ অভিনেতার দিন কাটে অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে। কখনো হুইলচেয়ারে, কখনো বিছানায় শুয়ে-বসে। পাশ্চাত্যের সিনেমায় দেখা যায় ৮০/৮৫ ঊর্ধ্ব বয়সেও অনেকে অভিনয় করছেন।

যেমন অ্যান্থনি হপকিন্স। ২০২১ সালে অস্কারের ৯৩তম আসরে 'দ্য ফাদার' ছবির জন্য ষষ্ঠ বারের মতো সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। এর আগে এই ছবির জন্য বাফটা অ্যাওয়ার্ডস পান। সবচেয়ে বেশি বয়সে সেরা পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার রেকর্ড গড়েন ৮৩ বছর বয়সি এই ওয়েলশ তারকা। পুরস্কারটি জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি। 'দ্য ফাদার' ছবিতে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে থাকা এক বৃদ্ধের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন হপকিন্স। আসলে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি গৎবাঁধা চরিত্রের বাইরে যেতে সাহস পায় না। ফলে এরকম কোনো কোনো শক্তিমান অভিনেতার অভিনয় অপরীক্ষিতই থেকে যায়।

বর্তমানে কয়েক বছর ধরে হাঁটুর সমস্যায় ভুগছেন তিনি। এ বিষয়ে প্রবীর মিত্রের ছেলে মিথুন মিত্র জানান, 'বাবা একদমই চলাফেরা করতে পারেন না। চলতি বছরই তার হাঁটুতে অপারেশন করাতে হবে। চিকিৎসক এমনই পরামর্শ দিয়েছেন। দেশেও হতে পারে অপারেশন।'

এর আগে ২০২২ সালের শুরুতে ভারতে অস্টিওপরোসিসে রোগের চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন প্রবীর মিত্র। এই রোগের ফলে তার হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। এখন সপ্তাহে তিনবার কেমো দেওয়া লাগে তার। বর্তমানে নীরবে নিভৃতে ও একাকিত্বে ধানমন্ডিতে ছেলের বাসায় দিন কাটাচ্ছেন এক সময়ের প্রাণবন্ত হাসির তুখোড় দিলখোলা এই অভিনেতা।

দীর্ঘ চার দশক সিনেমায় কাজ করা প্রবীর মিত্রের এখন সময় কাটে বই পড়ে আর টিভি সেটের সামনে। তবে এখনো মন তার ছুটে যেতে চায় এফডিসি প্রাঙ্গণে আর শুটিংয়ে। ছেলে মিথুন মিত্র আরও জানান, তার বাবার শ্রবণশক্তি যেন দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে তিনি ঠিকমতো কানে শুনতে পান না। উচ্চস্বরে কথা বললে উত্তর দিতে পারেন। তবে খাবার গ্রহণে কোনো সমস্যা হয় না।

প্রবীর মিত্র বলেন, 'মনে হয় হাজার বছর ধরে অভিনয় করি না। খুব মন চায় অভিনয় করি। এফডিসি যাই, আবার আড্ডা দেই পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে। এফডিসি যাওয়ার জন্য আমার মন কেবলই ছটফট করে। স্ত্রী বেঁচে নেই প্রায় ২০ বছর হলো। তার না থাকাও খুব মিস করি।' তিনি আক্ষেপের সুরে আরও বলেন, 'শিল্পী সমিতিও খোঁজ নেয় না। শিল্পীদের খোঁজ নেওয়া উচিত, কিন্তু নেয় না। কেন নেয় না, আমি জানি না।'

১৯৭১ সালে এইচ আকবরের 'জলছবি' সিনেমা দিয়ে রূপালীপর্দায় নিজের নাম লেখান প্রবীর মিত্র। এরপর তিনি দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পর্দায় নায়ক চরিত্রে যেমন সফল হয়েছেন, চরিত্রাভিনেতা হিসেবেও সমানভাবে আলো ছড়িয়েছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে চার শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন এই গুণী অভিনেতা। 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'চাবুক'-এর মতো সিনেমায় নায়কের ভূমিকায় দেখা গেছে প্রবীর মিত্রকে। এছাড়া 'রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা' সিনেমায় প্রধান চরিত্রে ছিলেন তিনি। এ কারণে অনেকে তাকে ঢাকাই সিনেমার 'রঙিন নবাব' বলে ডাকেন।

প্রবীর মিত্র যে ঢাকাই সিনেমায় একজন অভিনেতা হিসেবে কতটা প্রভাবশালী ছিলেন এটা আরও প্রমাণিত হয় যখন দেখা যাচ্ছে তাকে নিয়ে একের পর এক গুজব রটানো হচ্ছে। গুজব তো তাদের নিয়েই হয় যারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী। এমন গুজব অভিনেতা ফারুক বা আলমগীরকে নিয়েও হয়েছে। কারণ তারা তাদের অভিনয় জীবনে ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিনেতা। এই কিছুদিন আগে প্রবীর মিত্রকে নিয়ে আরেকটি গুজব রটানো হয় যে, তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছেন। পরে দেখা গেছে, সেটা ডাহা মিথ্যা।

এই গুজবের খবর উড়িয়ে দিয়ে তার ছেলে মিথুন মিত্র বলেন, 'আমার বাবা ধর্মান্তরিত হননি। এটা কীভাবে ছড়াল জানি না। আমাকে বেশ কয়েকজন ফোন করেও জানতে চাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ বিব্রত, একই সঙ্গে বিরক্ত। এসব গুজব কারা ছড়ায়, কীভাবে ছড়ায় আমি ঠিক জানি না।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে