শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
লোডশেডিংয়ের প্রভাব

শিল্প খাতে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা

উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে -বিকেএমইএ সভাপতি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে কর্মসংস্থানে ধস নামবে রপ্তানি বাণিজ্য সংকুচিত হবে
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৭ জুলাই ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ০৭ জুলাই ২০২২, ০৯:২২

গ্যাস-বিদু্যতের ক্রমবর্ধমান সংকটের কারণে দেশের শিল্পখাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্পের বিনিয়োগকারীরা বলেছেন, বিদু্যৎ ও গ্যাসের চলমান সংকটকে খুব দ্রম্নত সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব না হলে শিল্পখাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, রপ্তানি বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় ধস নামবে। ব্যাংক ঋণে চলা বিপুল সংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান নতুন করে কিস্তি খেলাপির তালিকায় যুক্ত হবে। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, দেশে বর্তমানে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠানের তহবিলের অন্যতম উৎস হলো ব্যাংক ঋণ। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের শিল্প উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যৌথভাবে এসব শিল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। স্বাভাবিক নিয়মে এসব প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময় পর পর ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করে থাকে। মূলত লাভের টাকা দিয়েই কিস্তি পরিশোধ করা হয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি বিদু্যৎ ও গ্যাসের লাগাতার সংকটের কারণে বিনিয়োগকারীরা ভীষণ আতঙ্কিত। ইতোমধ্যেই অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের আশঙ্কা, উৎপাদন ঘাটতির এই ধারা অব্যাহত থাকলে শিল্পখাতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তাতে বহু প্রতিষ্ঠান যেমন ঋণ খেলাপী হবে, তেমনি কাজ হারাতে পারে লাখ লাখ শিল্পশ্রমিক। এমনিতেই বিনিয়োগকারীদের 'ধীরে চলো' নীতির কারণে নতুন কর্মসংস্থান আশানুরূপ হারে হচ্ছে না। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নেতারা বলেন, এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হলো নিটওয়্যার। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ১ হাজার ৬০০ নিটওয়্যার ফ্যাক্টরিতে প্রায় ৯ লাখ লোক কাজ করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক গ্যাস ও বিদু্যৎ সংকটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছে শতভাগ রপ্তানিমুখী এই খাত। অধিকাংশ এলাকায়ই ১ ঘণ্টা বিদু্যৎ থাকলে পরের ১ ঘণ্টা থাকে না। এই হিসাবে দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টা বিদু্যৎ থাকে। বার বার বিদু্যতের আসা-যাওয়াজনিত বিভ্রাটের কারণে উৎপাদনের বেলায় দুর্গতি হয় আরও বেশি। এই বিভ্রাটের ফলে একদিকে পণ্যের গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী (বায়ারের অর্ডার) পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। সংকটময় এ পরিস্থিতিতে শিল্প মালিকরা জেনারেটরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। কিন্তু গ্যাস জেনারেটরের জন্য পর্যাপ্ত গ্যাসের প্রয়োজন, বাস্তবে যা মিলছে না। প্রায় দিনই সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ এতই কম থাকে যে, সেটা দিয়ে জেনারেটর কিংবা বয়লার কোনোটাই চালানো যায় না। এছাড়া রাত ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ একদমই থাকে না। ফলে ডায়িং ইউনিটগুলো ওই সময় বন্ধ থাকে। এ কারণে জেনারেটরের ওপরও নির্ভর করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ডিজেল জেনারেটর রয়েছে। কিন্তু ডিজেলের দাম অনেক বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচও অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তাছাড়া ডিজেল জেনারেটর একটানা চালানো যায় না। মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে চালাতে হয়। এতে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক উৎপাদন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পমালিকদের আশঙ্কা, বিদু্যৎ ও গ্যাসের এই সংকট দ্রম্নত সহনীয় পর্যায়ে আনতে না পারলে বিপর্যয় অবধারিত। এই অবস্থা চলতে থাকলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং সময়মতো শিপমেন্ট দেওয়া যাবে না। এমনটি টানা চলতে বায়াররা (বিদেশি ক্রেতা) আস্থা হারিয়ে অন্যদেশে চলে যাবে। ফলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজার হারাতে পারে। আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে রপ্তানি বাণিজ্য। সেই সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দ্রম্নত ব্যাংকের কাছে কিস্তি খেলাপি হয়ে পড়বে। এই প্রবণতা বাড়তে থাকলে বিপুল সংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। আর এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই কর্মহীন হয়ে পড়বে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। গাজীপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, এমন একজন শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলে শিল্প-কারখানায় বিদু্যৎ ও গ্যাসের নতুন সংযোগ নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে অনেকেই ব্যাংকের ঋণ নিয়ে নতুন ফ্যাক্টরি তৈরির পর তা চালু করতে পারছেন না। এছাড়া চালু থাকা ফ্যাক্টরিগুলোও প্রয়োজন মাফিক গ্যাস পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে শিল্প মালিকরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে ইতোমধ্যেই ব্যাংকের কিস্তি খেলাপি হয়ে পড়েছেন। বিষয়টি সম্পর্কে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতারা বলেন, বিদু্যৎ সংকটের কারণে শিল্পখাতের উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। জনজীবনও অতিষ্ঠ। এই অবস্থা আগামী ২/৩ মাস চলতে থাকলে শিল্প ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো ভয়াবহ সংকটে পড়বে। আর এম গ্রম্নপের কর্ণধার রাজীব আহমেদের দাবি, প্রতি বর্গফুটে যেখানে ১৫ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ারিংস) গ্যাসের চাপ থাকার কথা, সেখানে অনেক কারখানায় তা কমে মাত্র ২-৩ পিএসআইতে নেমে এসেছে। আবার কোনো কোনো কারখানায় পিএসআই শূন্যতে নেমে গেছে। গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে আর্থিকভাবে লোকসানে পড়ার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় বিশেষ করে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদামতো দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক সরবরাহ করতে না পারলে তারা ক্রয়াদেশ বাতিল করে দেবেন এবং বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দেশের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। কাশিমপুর এলাকার একটি গার্মেন্টসের প্রোডাকশন ম্যানেজার ইসমাইল হোসেন জানান, কারখানায় গ্যাসের চাপ কোনোভাবেই ৫-৬ পিএসআইয়ের ওপরে উঠছে না। তবে বেশিরভাগ সময়ই তা ৩-৪ এর মধ্যে থাকে। যে কারণে পালা করে কারখানার অর্ধেক অংশ সব সময় বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন ৫০ ভাগ কমে গেছে। এখন পিবিএস ও ডিজেল জেনারেটর দিয়ে যতটুকু সম্ভব, ততটুকুই চালানো হচ্ছে। আশুলিয়া এলাকার শিল্পকারখানার মালিক-কর্মকর্তারা জানান, তীব্র গ্যাস-সংকট থাকায় কারখানায় বয়লার চালাতে মুশকিল হচ্ছে। বয়লার সচল রাখতে প্রতিটি কারখানায় দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ডিজেল কিনতে হয়। কারখানার উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তাই বিদেশি ক্রেতাদের সময়মতো পোশাক সরবরাহ করতে শ্রমিকদের দিয়ে ওভারটাইম করাতে হচ্ছে। এভাবে শ্রমিকদের ওভারটাইম করানোর (অতিরিক্ত সময়ে কাজ করানো) কারণে দিনে তিন-চার লাখ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সব মিলিয়ে তারা শিল্পখাতে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি এমএ হাতেম যায়যায়দিনকে বলেন, 'গ্যাস ও বিদু্যৎ সংকটের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর ফলে আমরা সময়মতো শিপমেন্ট করতে পারছি না। যার প্রভাব পড়ছে ঋণের কিস্তি পরিশোধে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সময়মতো ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনেও এর প্রভাব পড়ছে। সবকিছু মিলিয়ে শিল্প উদ্যোক্তারা খুবই কঠিন সময় পার করছেন।' বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'বয়লার ছাড়া তো কোনো প্রসেসিং হয় না, সেখানে ডাইংয়ের কেমিক্যাল হয়। আমি কেমিক্যাল মিক্সড করে বয়লার স্টার্ট দিলাম, মেশিন চলছে কিন্তু হঠাৎ বয়লার থেকে স্ট্রিম বন্ধ হয়ে গেল গ্যাস না থাকার কারণে। ডাইংয়ের এই পুরো প্রসেসটা ফেলে দিতে হবে।' মোহাম্মদ আলী খোকন আরও বলেন, 'এই শিল্পটা যদি মরে যায় বা না টিকে তাহলে কি আমাদের টিকে থাকা সম্ভব? প্রতিদিন আমাদের রপ্তানি খাতে সুতার প্রয়োজন হলো ৮ থেকে ১২ মিলিয়ন কেজি। এই পরিমাণ সুতা কি প্রতিদিন আমদানি করে এক্সপোর্ট করা সম্ভব হতো? সরকারের কাজ হলো ব্যবসায়ীদের পলিসি সাপোর্ট দেওয়া, শিল্পের বিপস্নব ঘটানো।' এদিকে বিদু্যৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি বিদু্যৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুও স্বীকার করেছেন। প্রতিমন্ত্রী তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, 'গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদু্যৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গাতেই বিদু্যৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদু্যৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে। যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য সব দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে।' তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জ্বালানিভিত্তিক বিদু্যৎ কেন্দ্রের উপর অধিক নির্ভরতা, লোডশেডিংয়ে রেশনিংয়ে সমন্বয়হীনতার কারণে এ দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের ভাষ্য, দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদনে দুর্বলতার কারণে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে