সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আইনজীবীদের আদালত বর্জনে চরম দুর্ভোগে বিচারপ্রার্থীরা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা ও দায়রা জজ আদালত
স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
  ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা ও দায়রা জজ শারমিন নিগার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের অপসারণ ও জজ আদালতের নাজির মমিনুল ইসলামের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আইনজীবীদের আদালত বর্জনের কারণে আদালত প্রাঙ্গণে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন শত শত বিচার প্রত্যাশী।

বুধবার থেকে আইনজীবীদের ষষ্ঠ দফা আদালত বর্জন শুরু হয়, চলবে আগামী ১৬ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত।

এদিকে মাসাধিককাল ধরে আইনজীবীদের আদালত বর্জনের ফলে শত শত বিচারপ্রত্যাশী সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত শুধু জেলা ও দায়রা জজ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ ছাড়া অন্যসব আদালত যথারীতি চলে। কিন্তু বুধবার থেকে আবার সব আদালত বর্জনের ফলে বিচার প্রত্যাশী শত শত মানুষ আদালত প্রাঙ্গণে এসে বর্জনের কথা শুনে হতাশা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

সরাইল উপজেলার অরুয়াইল গ্রাম থেকে স্বামীর জামিন করানোর জন্য আসা চার সন্তানের জননী সালমা বেগম জানান, তার স্বামী প্রায় ছয় মাস ধরে মিথ্যা নারী নির্যাতন মামলার আসামি হয়ে হাজতবাস করছেন। দেড় মাস ধরে আদালত প্রাঙ্গণে ধরনা দিচ্ছেন স্বামীর জামিনের জন্য।

কিন্তু আইনজীবী ও বিচারকের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে আদালত বর্জনের কারণে স্বামীর জামিন করাতে পারছেন না। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে জানান, গত ৩ তারিখ (৩ ফেব্রম্নয়ারি) মামলার শুনানির তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু কোর্ট বর্জনের কারণে স্বামীর জামিন করাতে পারেননি। তিনি বলেন, আজ (বুধবার) আবার ধার্য তারিখে কোর্টে ওঠার সময় আইনজীবীদের বাধার কারণে তিনি কোর্টে প্রবেশ করতে পারেননি। তিনি জানান, স্বামী ছাড়া পরিবারে আর কেউ উপার্জন করার মতো নেই।

বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ইলিয়াছ মিয়া, সরাইল উপজেলার রসুলপুর গ্রামের মুমিনুল হক, আখাউড়া উপজেলার মনোয়ারা বেগম, কসবা উপজেলার শাহাদৎ মিয়া, নবীরনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের ইছা মিয়াসহ আরও কয়েকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা কোর্টে এসে শুনি আজ কোর্ট হবে না। আমরা দূর-দূরান্ত থেকে কষ্ট করে কোর্টে এসেছি। এখন শুনি কোর্ট হবে না। আমাদের আগে জানিয়ে দিলে আমরা কষ্ট করে আসতাম না।'

এদিকে আদালত বর্জন প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল বলেন, 'গত মঙ্গলবার পর্যন্ত দুটি কোর্ট ছাড়া সব আদালতের কার্যক্রমে আইনজীবীরা অংশগ্রহণ করেন। বুধবার থেকে সব কোর্ট বর্জনের ফলে প্রতিদিন ৮-১০ হাজার মানুষ বিচারিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।'

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. তানবীর ভূঞা বলেন, 'আমাদের দাবি মেনে নিলে আমরা এক মিনিটও বিলম্ব করব না। বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে আমরা এই কর্মসূচি বাড়াতে চাই না। তাছাড়া শত শত আইনজীবীদের রুটি-রুজির বিষয়ও এখানে জড়িত। তবে আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখব।'

উলেস্নখ্য, আদালতের শীতকালীন ছুটির আগে গত ১ ডিসেম্বর আদালতের শেষ কার্যদিবস ছিল। ওইদিন তিনটি মামলা না নেওয়ায় ১ জানুয়ারি থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জন শুরু করেন আইনজীবীরা। ২ জানুয়ারি বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে আইনজীবীদের বাদানুবাদের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে বিচারকের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগে গত ৪ জানুয়ারি আদালতের কক্ষে ও প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে এক দিনের কর্মবিরতি ও মানববন্ধন পালন করে জেলা বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন।

এ ঘটনার পর গত ৫ জানুয়ারি থেকে পুরো আদালত বর্জনের কর্মসূচি শুরু করেন আইনজীবীরা। তারা জেলা ও দায়রা জজ শারমিন নিগার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের অপসারণ ও জজ আদালতের নাজির মমিনুল ইসলামের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

এদিকে বিচারকের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগে সভাপতিসহ তিন আইনজীবীকে ১৭ জানুয়ারি উচ্চ আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।

এ ছাড়া আন্দোলন চলাকালে জেলা ও দায়রা জজের বিরুদ্ধে অশালীন সেস্নাগান দেওয়ার অভিযোগে ১১ জানুয়ারি ২১ আইনজীবীকে হাইকোর্টে তলব করা হয়।

এমন পরিস্থিতিতে ১২ জানুয়ারি রাতে ঢাকায় আইনমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠক করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা। বৈঠকে আইনমন্ত্রী আইনজীবীদের তিনটি দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে আদালতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আইনজীবীরা।

মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ২৪ জানুয়ারির মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ শারমিন নিগার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের অপসারণ ও ও জজ আদালতের নাজির মমিনুল ইসলামের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ওই দুই আদালত ছাড়া সব আদালতে ফিরে যান আইনজীবীরা। এতে আদালতের অচলাবস্থা দূর হয়।

গত ২৪ জানুয়ারির মধ্যে আইনজীবীদের দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা ওইদিন বিশেষ সাধারণ সভা করে তারা তাদের কর্মসূচি ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। ৩০ জানুয়ারি মধ্যে তাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় তাদের কর্মসূচি আবার ৭ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।

গত মঙ্গলবার আইনজীবীরা তাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় বিশেষ সাধারণ সভা করে আগামী ১৬ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত সব আদালত বর্জনের ঘোষণা দেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে