সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরের চার জেলায় পানিবন্দি অর্ধ লাখ মানুষ দুর্ভোগে

ভারত গজলডোবার গেট খুলে দেওয়ায় পরিস্থিতির অবনতি তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৪৫ সে.মি. ওপরে
যাযাদি ডেস্ক
  ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
কুড়িগ্রামের রাজারহাটে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ছবিটি শনিবার ঘড়িয়ালডাঙ্গার খিতাব খাঁ এলাকা থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

প্রবল বর্ষণ, উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং তিস্তা নদীর উজানে ভারত গজলডোবার গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশ অভিমুখে ধেয়ে আসছে পানি। এতে চতুর্থ দফায় উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও রংপুর অঞ্চলের নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পানিতে এখন টইটম্বুর তিস্তা, ঘাঘট, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়াসহ বিভিন্ন নদ-নদী। তিস্তা নদীর পানি শুক্রবার দুপুরেই বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে পানি বাড়ছে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতেও। এসব নদী-তীরবর্তী অঞ্চলের লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ায় উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে ফের চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী শনিবার তিস্তা নদীর পানি রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৭২ সেন্টিমিটার, ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ৯৭ সেন্টিমিটার ও দুধকুমারের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও নিচু চরাঞ্চলগুলোতে ফের বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের নতুন জেগে ওঠা মুসার চর ও বালাডোবার চরের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

রংপুরের কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া ও পীরগাছা উপজেলার ৪০টি চরাঞ্চলের গ্রামে পানি প্রবেশ করায় প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাড়িঘর ৩ থেকে ৪ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ধান-পাটসহ শস্য খেতগুলো তলিয়ে আছে পানিতে। পানিবন্দি মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে উঁচুস্থানে ও পাউবো বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ায় পানিবন্দি পরিবারগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদি পশুপাখি নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ফ্ল্যাড অথরিটি সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার গজলডোবা ব্যারেজ পয়েন্ট থেকে সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২ লাখ ১ হাজার ৬৪৭ কিউসেক এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪৮ কিউসেক পানি বাংলাদেশের দিকে ছেড়েছে ভারত। এতে তিস্তার ভারতের সংরক্ষিত এলাকায় হলুদ সতর্কতা জারি করা হলেও দোমহনী থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত সংরক্ষিত এলাকায় লাল সতর্কতা জারি করেছে সেচ দপ্তর।

অন্যদিকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় সিকিম দার্জিলিং ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলোতে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর জেলা জলপাইগুড়ি এবং শিলিগুড়িতে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে। সমতলের তুলনায় পাহাড় এলাকায় বৃষ্টির পরিমাণ আরও বেশি বলে জানিয়েছে ফ্ল্যাড অথরিটি সেন্টার।

রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার নদী-তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক দিনের গরমের পর টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এতে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বেড়ে যায়।

পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী-তীরবর্তী এলাকাগুলোয় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। সঙ্গে কিছু কিছু পস্নাবিত নিম্নাঞ্চলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

নদীপাড়ের মানুষেরা বলছেন, গত দুদিন ধরে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি দ্রম্নত বৃদ্ধি পেয়েছে। নীলফামারীর ডিমলার ছাতনা এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। এতে এসব এলাকার পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল পস্নাবিত হয়েছে। বড় বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তিস্তাপাড়ের মানুষজনেরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সকাল ৬টায় তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপৎসীমা হচ্ছে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। সেখানে ৫২ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। সেখানে পানি প্রবাহিত হচ্ছে ২৯ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার। কুড়িগ্রামে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

রংপুরের নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত এলাকাগুলোর মধ্যে গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর, নোহালী ও লক্ষ্ণীটারী ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম রয়েছে। কাউনিয়া উপজেলার ধুসমারার চর, আজম খাঁ চর, হাইবত খাঁ গোনাই, পলিস্নমারী, চর একতা, চর মিলনবাজার, গোপীকালস্না, ডালার চর ও চর গোদাই। এছাড়া পীরগাছার ছাওয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে।

অন্যদিকে লালমনিরহাটের ভোটমারী, তুষভান্ডারের আমিনগঞ্জ, কাকিনা, পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের অন্তত ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, তিস্তার পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। সে কারণে দুর্গম চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। অবিরাম বর্ষণ আর ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি আরও জানান, ভারতের উজানে পানি বৃদ্ধির কারণে গজলডোবা ব্যারেজের সবগুলো গেট পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই খুলে দেওয়ায় শুক্রবার থেকে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর পানি মারাত্মক বেড়েছে। তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে ৪৪টি গেটের সবগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রবল স্রোতের কারণে নদী-তীরবর্তী আশপাশের গ্রামগুলোয় পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। নতুন নতুন গ্রামে পস্নাবন হওয়ায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের গতিয়াসাম, চর খিতাবখা, বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চতুড়া, রামহরি ও কালিরহাট এলাকায় দেখা দিয়েছে তিস্তা নদীভাঙন। এছাড়া ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের কয়েকটি পয়েন্টে এবং ধরলার অববাহিকার মোগলবাসা ইউনিয়নের চরসিতাইঝাড় এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।

তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান মুন্সি রানা বলেন, 'তিস্তা নদীর পানি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার বাম তীরে ভাঙন চলছে। দেখার যেন কেউ নাই। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে তো অনেকে বাড়িঘর-জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অনেক মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।'

তিস্তা নদীর অববাহিকার গড়াই পিয়ার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল খালেক বলেন, 'তিস্তা নদীর পানি গতকাল থেকে হুহু করে বাড়ছে। আমরা এখানকার সবাই অনেক দুশ্চিন্তায় আছি। কেননা সবাই আমরা আমন আবাদ করেছি যদি সব নষ্ট হয়ে যায়। পানি বৃদ্ধির কারণে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে আমাদের।'

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুলস্নাহ আল মামুন বলেন, 'বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৮ আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এবং ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমারের বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে।'

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রণজিত কুমার সরকার জানান, শনিবার সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৪৪ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় আট সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৯০ মিটার)।

কাজিপুরের মেঘাই পয়েন্টে পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ১৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১৪ দশমিক ৮০ মিটার)।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে আবারও যমুনার পানি বাড়ছে। আগামী তিন দিন পানি বাড়বে এবং বিপৎসীমাও অতিক্রম করতে পারে। তবে ভারী কোনো বন্যার আশঙ্কা নেই।

রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের গতিয়াসাম, চর খিতাবখা, বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চতুরা, রামহরি ও কালিরহাট এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন।

শনিবার রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম বন্যা ও ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে অর্ধশতাধিক পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন।

তিস্তা পাড়ের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হিরা বলেন, 'তিস্তা নদী পানি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার বাম তীরে ভাঙন চলছে। এভাবে ভাঙন ভব্যাহত থাকলে তো অনেকে বাড়ি ঘর জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অনেক মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।'

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুলস্নাহ আল মামুন জানান, কয়েক দিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তার পানি আবারও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী চব্বিশ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশংকা রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে