শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

ঢাকার আকাশ মিত্রবাহিনীর দখলে

বীরেন মুখার্জী
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আপডেট  : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৩
ঢাকার আকাশ মিত্রবাহিনীর দখলে
ঢাকার আকাশ মিত্রবাহিনীর দখলে

একাত্তর সালের ৫ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ঢাকার আকাশ পুরো নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। পাকবাহিনীর প্রায় সমস্ত জঙ্গি বিমান নিঃশেষ। এই দিন সারা দেশে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আখাউড়া ও কোটচাঁদপুর পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করে নেয়। আখাউড়ায় ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি বড় অংশ আত্মসমর্পণ করে। কিছু সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আর কিছু সৈন্য জীবন বাঁচাতে আখাউড়া রেললাইন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যায়। বাকি সৈন্য প্রাণে বাঁচতে তিতাস নদীতে ঝাঁপ দেয়। ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ তারা ডুবে গেলে তিতাস নদীতেই তাদের মৃতু্য হয়। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার '৭১ এর দশমাস' গ্রন্থে লিখেছেন, 'এর আগে ৪ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ও মিত্র বিমান বাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ২৩০ বার হানা দেয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সিলেট সেক্টরে বোমাবর্ষণ করে শত্রম্নর পাঁচটি বাংকার উড়িয়ে দেয়। জামালপুর বিমান হামলায় হানাদার বাহিনীর কয়েকশ' সৈন্য নিহত হয়। বিধ্বস্ত হয় বহু সামরিক যানবাহন। ৫ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসে। মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে ঢাকার সঙ্গে কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, সিলেট, নাটোর, রংপুর, যশোর ও রাজশাহীর সড়কপথের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। জায়গায় জায়গায় অবস্থান নেয় তারা।' এই দিন সিলেটের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি কানাইঘাট থেকে বিকাল ৫টায় এমসি কলেজ অভিমুখে যাত্রা করে পরদিন বিকাল ৫টায় কেওয়াছরা চা বাগানে অবস্থান নেয়। কিন্তু এদিন রাতে আলফা কোম্পানির পেট্রোল পার্টি হানাদারদের অ্যামবুশে পড়ে। একজন নিখোঁজ হয়। পরদিন সকালে হানাদারদের অবস্থান জানার জন্য বের হলেও হানাদারদের বাধার মুখে পড়ে পিছু হটে পেট্রোল পার্টি ফের সংগঠিত হয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় তারা। এ সময় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। সন্ধ্যার পরে মুক্তিযোদ্ধারা এমসি কলেজের দিকে যাত্রা শুরু করেন। এদিন যশোরের চৌগাছাতে ট্যাংক যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে ভারতের ট্যাংক রেজিমেন্ট যুদ্ধ করে। তাদের সঙ্গে অবস্থান নিয়েছিল ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা। অপর একটি সেনাদল এগিয়ে যায় যশোরের দিকে। ওই দিন যশোর বিমানবন্দরের ওপরে আর্টিলারি ও মর্টার সেলের প্রচন্ড গোলাবর্ষণ হয়। কারণ সেখানে পাকিস্তানিরা শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। ওই দিন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী চুয়াডাঙ্গার দর্শনা শহর দখলে নেয়। দর্শনাতেও ছিল পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি। বিশাল ওই ঘাঁটিতে পাকিস্তানিদের পরাজয় শিকার করতে বাধ্য করতে সক্ষম হয় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। এদিন বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুমুল লড়াই শুরু হয়। মূল লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সে প্রস্তাবে ভেটো দেয়। কারণ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল সোভিয়েট ইউনিয়ন। আর যুক্তরাষ্ট্র, চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কিছু দেশ ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতিসংঘে প্রস্তাব পেশ করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান। এদিকে জাতিসংঘের কাছে চীনের প্রতিনিধিরা বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন, সে জন্য মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার '৭১ এর দশমাস' গ্রন্থে লিখেছেন, 'এই দিন ঢাকার আকাশে বিমানের ডগ-ফাইট। ঢাকায় অবরুদ্ধ নাগরিকরা দিনের আলোয় নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে এই আকাশযুদ্ধ উপভোগ করে এবং মিত্র বাহিনীর বিমানের পাইলটদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়। এই দিন সকালে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে এই ডগ-ফাইট চলে।' তথ্যসূত্র : '৭১ এর দশমাস', রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে