সোমবার, ২৬ মে ২০২৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শীতের পোশাক

মুহিব্বুলস্নাহ কাফি
  ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শীতের পোশাক
শীতের পোশাক

এবারের শীত বোধহয় আগেই চলে এল শহরে। ফজরের পরও কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারপাশ। কুয়াশা কেটে মিষ্টি রোদের দেখা পেতে বেলা প্রায় ন'টা। ছোট্ট জারিফের স্কুল সেই সকাল আটটায়। হু হু হা হা করতে করতে যেতে হয় স্কুলে। না যেয়ে উপায় কোথায়? আব্বু বের হন ন'টায়। আব্বু থাকাতে আম্মুর প্রতি রাগটা তেমন দেখাতে পারে না জারিফ। গত বছরের শীতের পোশাক পরেই মাথা নিচু করে চলে যেতে হয় স্কুলে।

জারিফ এবার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাবা-মার একমাত্র ছেলে। বেশ আহ্লাদি। কিন্তু আব্বুর চোখ দেখেই চুপসে যায় রাগে গজগজ করতে থাকা জারিফ। কোনো কিছু প্রয়োজন হলেও আব্বুর কাছে চায় ও। সব চাওয়া-আবদার, মানঅভিমান আম্মুর কাছে। কিছুর প্রয়োজন হলেই আম্মুর দরবারে হাজির জারিফ। আম্মু আব্বুর কানে দেন ওর প্রয়োজনীয় আবদারগুলো। কোনোটা পাস হয় কোনোটা বাতিল। আবদার বাতিল বা আম্মু আব্বুর কাছে আবদারের কথা না জানালে শুরু হয় তুলকালাম। তবে আব্বু বাসায় থাকলে জারিফ নীরব। মনের ভেতর তুফান চললেও বাইরে লক্ষ্ণীটি।

1

আব্বু জারিফের প্রতি কঠোর বা তিনি খুব শাসন করেন এমনও নয়। আদর সোহাগ করেন। খেতে না চাইলে মুখে তুলে খাইয়ে দেন। তবুও জারিফ আব্বুর কাছে কোনো কিছুরই আবদার করে না। করে আম্মুর মাধ্যমে।

সে যাই হোক, জারিফ আজ স্কুল থেকে এসেই স্কুলব্যাগটা ছুড়ে মারল। স্কুলব্যাগটা কোথায় গিয়ে পড়ল তা দেখার কোনো ফুরসত নেই এখন। গতকালের মতোই আজও ভঁ্যা ভঁ্যা শুরু করে দিল জারিফ। জারিফের আম্মু কিছুতেই বুঝিয়ে পারছেন না। তার আজ শীতের পোশাক লাগবেই লাগবে। জারিফের আম্মু বারবার বোঝানো পরও জারিফ থামছে না। তার কথা, স্কুলে সবাই নতুন নতুন শীতের পোশাক পরে আসে আর আমি সেই পুরোনোটাই পরে যাই। ভালো লাগে না। আমার নতুন শীতের পোশাক চাই।

কিন্তু তোমার তো দু'টা শীতের পোশাক আছে। একটা তোমার শরীরে। আরেকটাই এই। ড্রয়ার থেকে দ্বিতীয়টা বের করতে করতে বললেন জারিফের আম্মু। দেখ, এখনো চকচক করছে। জারিফ এবার তার পরনের শীতের পোশাকটাও খুলে ফেলল।

নিজের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, হঁ্যা, তোমাকে বলেছে, গত বছরের শীতের পোশাক এখনো চকচক করছে! জারিফ মুখে ভেংচি কেটে আবারও ভঁ্যা ভঁ্যা শুরু করে দিল।

এমন সময় জারিফের আম্মুর মোবাইল বেজে উঠল। জারিফের ছোট মামা ফোন করেছেন। কথা বলার মাঝে শুনতে পেলেন জারিফের গোঙানির আওয়াজ। জানতে চাইলে জারিফের আম্মু বললেন, আর বলিসনে ভাই। জারিফ খুব জ্বালাতন করছে। দু'টা শীতের পোশাক থাকার পরও বয়না ধরেছে শীতের পোশাক কিনে...

জারিফের আম্মু কথা শেষ করার আগেই চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠল জারিফ, মামাকে এটা বল শীতের পোশাক দুটোই পুরাতন।

এক বছর হলেই কি পুরাতন হয়ে যায়? জারিফের আম্মু এবার চেঁচিয়ে উঠলেন।

জারিফ মোবাইলটা আম্মুর থেকে নিয়ে বলল, জান মামা, আমার ক্লাসে সবাই নতুন শীতের পোশাক পরে আসে। আর আমিই শুধু পরি পুরাতন... বলেই জারিফ আবার ভঁ্যা ভঁ্যা শুরু করে দিল। মামা মোবাইলের ওপাশ থেকে জারিফ জারিফ বলে চিৎকার করে যাচ্ছেন। কিন্তু জারিফ আম্মুকে মোবাইলটা দিয়ে দৌড়ে তার রুমে চলে গেল। কান্না যেন তার হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল।

পরদিন জারিফ স্কুলেই যেতে চাইল না। তবু আব্বুর ভয় দেখিয়ে আম্মু ঠেলেঠুলে পাঠালেন। জারিফ হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে গেল স্কুলে। স্কুল করল। ছুটি হলো। জারিফ বাসার দিকে আসছে আর ভাবছে, আজ বাসায় যেয়ে নিই। সব এলোমেলো করে ফেলব। এখন আব্বু তো বাসায় থাকেন না।

বাসায় এসে কলিং বেল চাপ দিল। দরজা খুললেন জারিফের ছোট মামা।

জারিফের মামা পাশেই একটা অফিসে জব করেন। সেই সুবাদে সুযোগ পেলেই জারিফকে দেখতে চলে আসেন। তাই চলে আসলেন জারিফকে দেখতে।

মামাকে দেখে কান্না আর ধরে রাখতে পারল না ও। গতকাল তো মামা সব জেনেছেনই। জারিফ ভঁ্যা ভঁ্যা করতে করতে মামাকে জড়িয়ে ধরল। মামা ওকে কোলে তুলে নিলেন। জারিফ ঠোঁট ভেঙে ভেঙে শরীরে থাকা শীতের পোশাকটা দেখিয়ে বলল, মামা দেখো, এটা কি নতুন পোশাক?

মামা জারিফের কথার সাথে সহমত প্রকাশ করে বললেন, তাই তো, এটা তো অনেক পুরোনো। কে বলে এটা নতুন?

মামার মুখে 'পুরোনো' কথা শুনে জারিফের কান্না যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

মামা জারিফকে কোলে নিয়ে দরজা লাগিয়ে ওর রুমে গেলেন। বললেন, মামা জারিফ দেখতো টেবিলে ওটা কী?

জারিফ কোলে থেকেই আড়চোখে তাকাল ওর পড়ার টেবিলে।

দেখেই তো ওর চোখ ছানাবড়া। এটা তো দেখি নতুন শীতের পোশাক।

জারিফ মামার কোল থেকে নামল। স্কুলব্যাগ তখনও তার কাঁধে। স্কুলব্যাগ নামাল কাঁধ থেকে। শীতের নতুন পোশাকটা ঝটপট পরে নিলো। জারিফের আম্মু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন সব। জারিফ নতুন শীতের পোশাকটা আম্মুকে দেখিয়ে বলে উঠল, 'আম্মু দেখেছো, মামা আমার জন্য কত সুন্দর শীতের পোশাক এনেছেন!' আম্মুর প্রতি তার অভিমান উবে গেছে।

জারিফের আম্মু মাথা নেড়ে একটা মুচকি হাসি দিলেন।

হঠাৎ ফের কলিং বেল বেজে উঠল। এখন কে আসল? আব্বু তো অফিসে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। তবে পাশের ফ্ল্যাটের কামাল মাঝেমধ্যে আসে। ছাদে গিয়ে একসাথে খেলাধুলা করে।

আজও হয়তো কামাল এসেছে ভেবে গেইট খুলতে দৌড় দিল জারিফ। কামালকে শীতের নতুন পোশাক দেখিয়ে বলবে, কামাল দেখো, এই যে আমার শীতের নতুন পোশাক। আমার মামা এনেছেন। কামাল চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলবে, বেশ সুন্দর তো!

কিন্তু না। জারিফ গেট খুলে দেখল একজন বৃদ্ধ মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে পুরোনো থালা। পাশে তার সমবয়সী একটি ছেলে মহিলার শাড়ি ধরে জারিফের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জারিফকে দেখে মহিলাটি বললেন, বাবা কিছু ভিক্ষা দিবা?

ভেতর থেকে আম্মু বললেন, জারিফ কে এসেছে?

জারিফ বলল, আম্মু একজন মহিলা এসেছেন। কিছু চাইছেন।

আম্মু ভিক্ষুক ভেবে কিছু টাকা দিয়ে গেইট লাগিয়ে দিলেন।

জারিফ এবার তার আম্মুকে বলল, আচ্ছা আম্মু এক কাজ করলে কেমন হয়, আমার তো এখন শীতের নতুন পোশাক হয়েছে। পুরাতন শীতের পোশাকটা যদি ওই ছেলেকে দিয়ে দিই। দখলাম ওর শরীরে পাতলা একটা শার্ট। হয়তো শীতের পোশাক নেই।

আম্মু বললেন, হুম, তা তো ভালই হয়।

মামা বললেন, দ্রম্নত যাও। না হয় উনারা চলে যাবেন।

আম্মু ও মামার সম্মতি পেয়ে জারিফ যারপরনাই খুশি হল। তার পুরোনো একটা শীতের পোশাক নিয়ে দিল ছুট। বাসার নিচে গিয়ে দেখল ছেলেটি তখনও শাড়ি ধরে হাঁটছে মায়ের পিছু পিছু। বেশ দূরে চলে গেছে তারা। জারিফ হাঁক ছাড়ল, এই যে শুনেন।

মহিলাটি পেছন ফিরলেন, ছেলেটিও।

জারিফ শীতের পোশাকটা ওই ছেলেকে দিলো এবং মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,

কিছু মনে করবেন না। আমার আরো শীতের পোশাক আছে। আমি এটা ওকে দিয়ে দিলাম। মহিলাটি জারিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আলস্নাহ তোমারে অনেক বড় বানাক।

জারিফ বাসার দিকে হাঁটছে আর একরাশ আশা নিয়ে ভাবছে, এরকম আর কাউকে পেলে ও ওর পুরোনো অন্য পোশাকটাও দিয়ে দেবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে