রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারে রাখাইনদের বৃষ্টিস্নাত বর্ষা উৎসব

জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
  ১৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
রাখাইন সম্প্রদায়ের অন্য রকম মিলনমেলা, বর্ষা উৎসবে তরুণীদের আড্ডা -যাযাদি

ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। দিনভর মুষলধারে বৃষ্টি। এ যেন বর্ষার চিরচেনা রূপ! বৃষ্টিস্নাত অনাবিল পরিবেশে একপাশে সাগরের উত্তাল ঢেউ, অন্যপাশে সারি সারি সবুজ ঝাউবন। বৃষ্টির সঙ্গে হিমেল হাওয়ার পরশ। এমনই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সাগরতীরে জমে উঠেছে রাখাইনদের বর্ষা উৎসব। রাখাইন সম্প্রদায়ের অন্য রকম এক মিলনমেলা। বর্ষার মধ্যে সমুদ্রস্নান আর নাচ-গানের আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ঝাউবীথির বালিয়াড়িতে প্রতি শুক্রবার বর্ণিল বর্ষা উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

প্রতি শুক্রবার দিনব্যাপী তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সি মানুষের মিলনমেলা বসছে এখানে। আয়োজকরা জানান, শৈবাল পয়েন্টে ২ মাস পর্যন্ত চলবে এই উৎসব। প্রতি বছর বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুই মাসব্যাপী আষাঢ়ী পূর্ণিমার আগে (আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত) সৈকতে এ উৎসব পালন করে থাকে রাখাইন সম্প্রদায়।

শুক্রবার দুপুরে সৈকতের শৈবাল পয়েন্টের ঝাউবাগানে রাখাইনদের মন রাঙানো 'বর্ষা উৎসবে' গিয়ে দেখা যায়, শহরের বিভিন্ন রাখাইন পলস্নী থেকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তরুণ-তরুণীরা সৈকতের ঝাউবাগানে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বৃষ্টিস্নাত আড্ডায় অনন্দমুখর পরিবেশে আড্ডায় মেতে উঠেছেন। তারা খাবার-দাবার আলাপচারিতা আর বিশেষ পানীয় পান করে সময় পার করছেন। তাদের খাবার তালিকাও বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাড়ি থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন নিজেদের পছন্দের হরেক রকমারি খাবার। ব্যাঙের মাংস, মুরগি, গরু ভুনা, মাছ, কাঁকড়া, ঝিনুক, কেউবা মুন্ডি (নুডলস জাতীয় রাখাইনদের বিশেষ খাবার), কেউবা বাঁশ কুরুল, লইব্যা (লম্বা সীম) দিয়ে চিংড়িসহ নানা রকমের খাবার। সৈকতের ঝাউবীথিতে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে শুরু হয় বৃষ্টিতে ভেজার পর্ব। পাশাপাশি উদ্দাম, উচ্ছল নাচ-গানে মেতে ওঠেন তারা। ঝুম বৃষ্টিতে যাদের মন ভেজাতে পারেনি তারা তখন নেমে পড়েন সাগরে। হিমেল ঢেউয়ের সঙ্গে যেন আনন্দে তারা ভেসে যান। দিনশেষে একসঙ্গে বাড়ি ফেরেন তারা।

রাখাইনরা জানান, এটি তাদের কোনো সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসব নয়, সবাই মিলে বর্ষায় আনন্দ করার জন্যই ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে পিকনিক করা ছাড়া কিছু নয়। এর সঙ্গে ধর্ম, সংস্কৃতি বা কৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে বর্ষায় বৃষ্টি এবং সাগরের জলে সিক্ত হয়ে আনন্দে মেতে ওঠাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। অনেক আগে থেকে বর্ষা মৌসুমে বন বাদাড়ে, পাহাড়ে কাঠ সংগ্রহ করতে যেত তাদের পূর্বপুরুষরা, সেই স্মৃতি জাগরূক রাখতে এই আয়োজন চলে আসছে।

রাখাইন নেত্রী মা টিন টিন বলেন, 'বর্ষা উৎসবটা যেহেতু তারুণ্যনির্ভর, তাই উচ্ছ্বাসও চোখে পড়ে বেশি। এই উৎসব ঘিরে দুই মাস ধরে চলে অন্য রকম আনন্দ। সময়ের ব্যবধানে বাড়ছে এ উৎসবের জনপ্রিয়তা। অনেক দিন ধরে রাখাইন সম্প্রদায় এ উৎসব পালন করে আসছে। বর্ষায় সৈকতে রাখাইন সমাজের পরিবার, বন্ধুমহল ও আত্মীয়স্বজন দল বেঁধে নানা রকমের খাবার নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন। বিশেষ করে সমুদ্র আর প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে পেতে সৈকতের ঝাউবাগানে আয়োজন করা হয় মনরাঙানো এই বর্ষা উৎসবের।

রাখাইন নেতা মংখিনছেন বলেন, 'মূলত সবাই মিলে বৃষ্টি এবং সাগরের জলে সিক্ত হয়ে মন রাঙানোর জন্যই এখানে আসি। এটি ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো উৎসব নয়, সবাই মিলে-মিশে বৃষ্টি এবং সাগরের জলে সিক্ত হয়ে মজা করা। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংঘাত হানাহানি ভুলে সবাই মিলে সারাদিন আনন্দে মেতে থাকার জন্যই মূলত এ আয়োজন। সবার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন দেখে সত্যিই ভালো লাগছে। রাখাইনরা শুধু মজা করার জন্য এ উৎসব শুরু করলেও এখন এটি শুধু রাখাইনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিতে চলেছে।'

এই বর্ষা উৎসবে কক্সবাজার শহরের রাখাইনদের পাশাপাশি সৈকতের ঝাউবনে হাজির হয় টেকনাফ, চকরিয়া, হারবাং, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগডাছড়ি, বান্দরবান, মহেশখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের রাখাইনরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে