শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
কেরানীগঞ্জ গণহত্যা দিবস আজ

'মানুষগুলোকে খাল ও বিলের মধ্যে গুলি করে মারা হয়'

কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি
  ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
'মানুষগুলোকে খাল ও বিলের মধ্যে গুলি করে মারা হয়'

একাত্তরে বাঙালির ইতিহাসের ভয়াল কালরাত ২৫ মার্চ। ২৫ মার্চের পর অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকার আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেসব পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে, তার মধ্যে কেরানীগঞ্জের গণহত্যাই প্রথম। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতায় কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, শুভাঢ্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নজুড়ে সংঘটিত ওই হত্যাযজ্ঞে নিহত হন প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু।

সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সে সময়ের ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী (প্রয়াত), শাজাহান সিরাজ, মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ অনেকে। পরে একই কবরে ১০ থেকে ১২টি করে লাশ দাফন করা হয়। কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নিতে আসা নাম-না-জানা ৫৪ জনকে দাফন করা হয়। সেদিনের নির্মম হত্যাকান্ডে জিনজিরা, মনু ব্যাপারীর ঢাল, নজরগঞ্জ, গোলজারবাগ, মান্দাইল, কুশিয়ারবাগ, বড়িশুর ও মাদারীপুর এলাকা লাশের স্তত্মূপে পরিণত হয়। সম্প্র্রতি কেরানীগঞ্জের মনু ব্যাপারীর ঢাল, নজরগঞ্জ, কসাইভিটা ও নেকরোজবাগ ঘুরে কয়েকটি গণকবর চোখে পড়ে। মনু ব্যাপারীর ঢালে ওই দিন একসঙ্গে প্রায় সাড়ে চারশ' মানুষকে হত্যা করা হয়। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে একটি স্মৃতিসৌধ।

কেরানীগঞ্জে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম বলেন, সেদিনের ভয়াবহ দৃশ্য আসলে বর্ণনা করার মতো না। কেউ দৌঁড়াতে গিয়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে, কেউ জীবনের শেষ মুহূর্তে পানি পানি করে চিৎকার করছে। বুলেটের আঘাতে কারও পেটের ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে।

এদিনের স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা জেলা কমান্ডার ও কেরানীগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মহসীন মন্টু। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর যায়যায়দিনকে জানান সে দিনের কথা। তখন তার বয়স ছিল ২৬ বছর। সেদিন সাক্ষাৎ মৃতু্যর হাত থেকে তার মতো কয়েকজন সৌভাগ্যবান বেঁচে গেলেও পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে অর্ধশতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন।

তিনি জানান, '২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়ে আমরা তখন কেরানীগঞ্জে সবাইকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যেই আমাদের কাছে খবর আসে, পাকিস্তানি বাহিনী কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ইউনিয়নে আক্রমণ করতে পারে। এই খবর পেয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝিদের বলে দিলাম, এই এলাকার ভেতর যেন কোনো নৌকা না থাকে। আমাদের ধারণা ছিল পাকিস্তানি বাহিনী হয়তো নৌকা নিয়েই পার হবে। মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, হঠাৎ আমাদের মধ্যে লালকুঠি এলাকা থেকে এক ছেলে এসে জানালো, সদরঘাট থেকে সেখানে কয়েকটি লঞ্চ এনে রাখা হয়েছে। মিডফোর্ড হাসপাতালের এক সহযোদ্ধা জানায়, আর্মির লোকেরা হাসপাতালের ওপরের তলাটা দখলে নিয়ে নিয়েছে। তখন আমরা আক্রমণের ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হই। পরদিন ফজরের আজানের সময় থেকেই শুরু হয় আক্রমণ।'

মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, ভোররাতে জিনজিরার দিকে লঞ্চ আসতে শুরু করলে আমাদের এক ছেলে ওই লঞ্চ লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পাল্টা জবাব আসতে দেরি হয়নি। তখন আমরা যা বোঝার বুঝে গেলাম। নদীর ধার থেকে শুরু হলো মর্টার শেলিং। মেশিনগানের গুলিতে পাখির মতো মানুষ মরল।

কমান্ডার মন্টু জানান, আক্রমণের আভাস পেয়ে আগের দিনই মাইকিং করে স্থানীয়দের সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে সবকিছু খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। প্রতিরোধের কোনো উপায়ই ছিল না। তখন কেরানীগঞ্জের খালগুলো ছিল শুকনো। ভয়ার্ত মানুষগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে এসে ওই খালে ও বিলের মধ্যে গুলি করে মারা হয়। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অন্তত ৪ থেকে সাড়ে ৫ হাজার মানুষ মারা পড়ে। যাদের বেশিরভাগ ছিলেন ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা। কারণ তারা এখানকার পথঘাট চিনতেন না।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসান মোস্তান বলেন, গুলির শব্দে মানুষ দিগবিদিক ছুটাছুটি শুরু করে। জীবন বাঁচাতে আমিও মান্দাইলে নিজ বাড়ি থেকে পাশের কালিন্দী গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। দেখলাম, সেখানেও ৫০-৬০ জন অচেনা যুবক জড়ো হয়েছে। কিন্তু হানাদান বাহিনী সেখানেও হাজির হলো। পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেও ১০-১২ জন ধরা পড়লাম। সবাইকে সার বেঁধে দাঁড় করায় সেনারা। এরপর গুলি চালায়। ওই দিন আমি ছাড়া লাইনে দাঁড় হওয়া সবাই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিল।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মো. শাহজাহান বলেন, ২ এপ্রিল কেরানীগঞ্জে পাঁচ হাজারের বেশি নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী। জ্বালিয়ে দিয়েছিল হাজার হাজার ঘরবাড়ি। ওই দিন তিনি তার ভাইবোনসহ নিকট আত্মীয়দের হারিয়েছেন। ২ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি সেনারা কেরানীগঞ্জে হামলা চালালে স্থানীয় যুবকরা প্রথমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শেষে চলে গেলে সন্ধ্যার পর শহীদদের লাশ কালিন্দী, নেকরোজবাগ, ইমামবাড়ি, কসাইভিটা, নজরগঞ্জ ও কালীগঞ্জ কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থানে গণকবর দেওয়া হয়। এক একটি কবরে ৪০-৫০ জনকেও রাখা হয়। এমনকি ধানক্ষেতে শহীদদের মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।

সেদিনের স্মরণে কেরানীগঞ্জের মনু ব্যাপারীর ঢালে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রতিবছর এই দিনটিকে কেরানীগঞ্জবাসী গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করেন। দিনটি স্মরণে কালো পতাকা উত্তোলন, জাতীয় পতাকা অর্ধনর্মিত রাখা, কালো ব্যাজ ধারণ, শোক মিছিল, আলোচনা সভা ও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে