ভোলার বোরহানউদ্দিনে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি কেঁচো সারের (ভার্মি কম্পোস্ট) ব্যবহার ফিরিয়ে আনছে নিরাপদ সবজি উৎপাদন। সবজি চাষে ওই সার ব্যবহারে সফলতা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট)। সেই সঙ্গে কেঁচো সারের ম্যাজিক ফিরিয়ে আনছে নিরাপদ সবজি, নিরাপদ ফল।
ব্যক্তি পর্যায়ে এলাকায় অল্প-স্বল্প কেঁচো সার উৎপাদন হলেও প্রায় শূন্য থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন বোরহানউদ্দিনের উদ্যোক্তা রাকিব। শুরুতে ১০টি রিং দিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করলেও এখন তার রিংয়ের সংখ্যা ১৫০টি। এছাড়া পাকা চেম্বার ৫০টি। প্রতি মাসে তার সার উৎপাদন হয় প্রায় ১৫ টন। পাইকারি কেজি প্রতি ১৫ টাকা দরে বিক্রি করেন। মাসে বিক্রি নামে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া কেঁচো সার উৎপাদনে ব্যবহৃত কেঁচোর বংশবৃদ্ধি হয়। অতিরিক্ত কেঁচো তিনি ৪ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে রাকিবের মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা লাভ হয়। জেলার বিভিন্ন উপজেলা ক্রেতারা সার নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ক্রেতার চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খান।
রাকিবের এ প্রজেক্ট উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে পৌর এলাকার দুই নাম্বার ওয়ার্ডে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, তার বাসার পাশে একটি লম্বা টিনের চালার ঘর। ঘরের গায়ে সাইনবোর্ড। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের লেখা- কমিউনিটি বেইজড ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন। ঘরের ভেতর পাকা চেম্বার ও রিংয়ের সারি। রিংয়ে উপাদান ও কেঁচো দেওয়া। পাশেই খোলা জায়গায় কম্পোস্ট পৃথকীকরণ মেশিনের মাধ্যমে আলাদা করে সার সংগ্রহ, ওজনের পর বস্তায় নেওয়ার কাজ চলছে। সহকারীদের সঙ্গে ব্যস্ত উদ্যোক্তা রাকিবও। নতুন অনেকে সেখানে প্রবেশ করে কেঁচো দেখলে হয়তো গা ঘিন ঘিন করে উঠবে। কিন্তু তারা হাসিমুখে কাজ করে যাচ্ছেন।
রাকিব বলেন, '২০২১ প্রথমে ইউটিউবে দেখে এ সার উৎপাদনে আগ্রহ জাগে। পরে স্থানীয় কৃষি অফিসে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কৃষি অফিস ১০টি রিংসহ আর্থিক সহায়তা দেয়। তারা কিছু কেঁচোও দেয়, কিন্তু ওগুলো মারা যায়। পরে যশোর থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে দুই কেজি কেঁচো কিনে এনে শুরু করি। এখন আমার এখানে ৬-৭ জন শ্রমিক কাজ করে। পাশাপাশি মা-বাবার সহযোগিতাও পাই।' রাকিব জানান, এ কাজ তাকে আনন্দ দেয়। কারণ তিনি মাটির প্রাণ ফিরিয়ে দিতে জৈব সার তৈরি করছেন। এছাড়া এটা তার পরিবারের আয়েরও উৎস। মানুষ নিরাপদ ফসল চায়। যখন শুরু করেন তখন এলাকার অনেকে বলেন- এটা পাগলামি। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল, তাই সফলতা পেয়েছেন। ধৈর্য নিয়ে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। কৃষি অফিসের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেও তিনি জানান। রাকিব কৃষি অফিসের অনুমোদনক্রমে 'ইকো গ্রো অর্গানিকস' নামে তার উৎপাদিত সার বিক্রি করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উর্বর মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকার কথা। এতে মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা ও বায়ু চলাচলের সুযোগ বাড়ে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ এলাকায় মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশ। তাই মাটিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ালে মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা বাড়বে। ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার মাটিকে নরম করে এবং পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন অণুজীবের বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে ক্রমেই ভূমির উর্বরতা কমে যেতে থাকে।
তথ্যে আরও জানা যায়, ভার্মি কম্পোস্ট সারে গাছের অত্যাবশ্যকীয় ১৬টি খাদ্য উপাদানের ১০টিই বিদ্যমান। গবেষণায় দেখা গেছে, আদর্শ ভার্মি কম্পোস্টে জৈব পদার্থ ২৮ দশমিক ৩২ ভাগ, নাইট্রোজেন ১ দশমিক ৫৭ ভাগ, ফসফরাস ১ দশমিক ২৬ ভাগ, পটাসিয়াম ২ দশমিক ৬০ ভাগ, ক্যালসিয়াম ২ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম শূন্য দশমিক ৬৬ ভাগ, সালফার শূন্য দশমিক ৭৪ ভাগ, বোরন শূন্য দশমিক শূন্য ৬ ভাগ, আয়রন ৯৭৫ পিপিএম, ম্যাঙ্গানিজ ৭১২ পিপিএম, জিঙ্ক ৪০০ পিপিএম এবং কপার ২০ পিপিএম রয়েছে। এই সার ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বাড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
বোরহানউদ্দিন পৌর শহরের সার, বীজ, কীটনাশক পরিবেশক বশির আহমেদ জানান, রাকিবের উৎপাদিত কেঁচো সার এখানে পাওয়া যায়। সারের গুণগত মান ভালো। কৃষক পর্যায়ে যথেষ্ট সাড়া আছে।
ওই বস্নকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাছির খাঁন বলেন, 'রাকিব পরিশ্রমী। কৃষি অফিস সব ধরনের সাপোর্ট নিয়ে তার পাশে আছে।'
বোরহানউদ্দিন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোবিন্দ মন্ডল বলেন, অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় প্রাকৃতিক পুষ্টি বাগান প্রকল্পের আওতায় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে এ সার উৎপাদন করা হচ্ছে। বড় পরিসরে কেউ উদ্যোগ নিলেও তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন।