সাদামাটির নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে ঘিরে নেত্রকোনায় রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। ভৌগোলিক নিদর্শন হিসেবে স্থানটি স্বীকৃতি পাওয়ায় এর কদর বেড়েছে সর্বত্র। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে দিন দিন স্থানটির গুরুত্ব বাড়ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও সম্ভাবনা দেখাচ্ছে সাদামাটি। এই সাদামাটি চিনামাটি হিসেবেও পরিচিত।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা। দুই সীমানায় পাহাড়, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সোমেশ্বরী নদী। গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলে এসেছে আমূল পরিবর্তন। ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতি ঘটছে সবার কাছে। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখো পর্যটক ভিড় করেন আশপাশের বিভিন্ন স্পটে। তবে সবার আকর্ষণ সাদামাটির পাহাড়। অক্টোবর থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত পর্যটকদের আনাগোনা থাকে সবচেয়ে বেশি। তাদের ঘিরে স্থানীয় অনেকের রোজগার।

স্থানীয়দের মতে, আগের চেয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সহজেই মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে যেতে পারছেন সীমান্তের কাছে। এখানে আসতে প্রায় প্রতিটি সড়ক এখন পাকা। সম্ভাবনাময় এই পর্যটনকে কেন্দ্র করে পর্যটনশিল্পের জন্য অবকাঠামোসহ পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করলে এই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। এ ছাড়া এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটন খাত থেকে বছরে অন্তত শত কোটি টাকার রাজস্ব আয়ও হবে। আরজ আলী (৬৫)। ঘুরতে আসা পর্যটকদের গান শুনিয়ে মাতিয়ে তোলাই হচ্ছে তার পেশা। সারাদিনই সাদামাটির পাহাড়ে বিচরণ তার। পর্যটকদের গান শুনিয়ে ১০-২০ টাকা করে বকশিস নেন। দিন শেষে যা পান, তা দিয়েই চলে আরজ আলী বাউলের সংসার।

স্থানীয় ইজিবাইক চালক শান্ত মিয়া (২৮)। পর্যটক ঘিরেই তার রোজগার। তবে শীত মৌসুম এলেই বাড়ে রোজগার। তিনি বলেন, 'আমি পর্যটকদের বিভিন্ন স্পটে ঘুরাই। আমার রোজগার তাদের থেকেই। সারাবছরের মধ্যে  এই শীতকালেই বেশি পর্যটক আসেন। বাকি সময় অল্পসংখ্যক মানুষ আসেন। তখন আয় একদমই কম থাকে। আমার মতো অনেকেই অটো চালিয়ে সংসার চালান।'

সাদামাটির পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ছবি তুলে দেন ফটোগ্রাফার দিদারুল ইসলাম (২৫)। গত দুই বছর ধরে এখানে রয়েছেন। তিনি বলেন, 'এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের ছবি তুলে দেই। তারাও এখানকার সৌন্দর্যের সঙ্গে নিজেকে ক্যামেরাবন্দি করে অনেক আনন্দিত হন।  শীতকালেই পর্যটকদের সিজন। বলা যায়, তখন আমাদের রোজগার বাড়ে।'

কেবল আরজ আলী, ফটোগ্রাফার দিদারুল ইসলাম এবং ইজিবাইক চালক শান্ত নন, কয়েক হাজার মানুষের রোজগার সেখানকার পর্যটক ঘিরেই। সম্ভাবনাময় এই উপজেলা ঘিরে স্থানীয় অর্থনীতির বৈপস্নবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে করছেন স্থানীয় ও পর্যটকরা। শুধু প্রয়োজন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।

স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীর পালোয়ান বলেন, 'এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিদ্যমান। আমাদের এলাকায় অনেক মানুষ ঘুরতে আসেন। কিন্তু তারা একটু কষ্টে পড়েন। যেমন- টয়লেট ব্যবস্থা, ক্লান্ত হয়ে গেলে কোনোরকম বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। বিভিন্ন সময় তারা আমাদের বাড়িতে এলে আমরাও সহযোগিতার কমতি রাখি না।'

যশোর থেকে ঘুরতে আসা হাসিবুল হক বলেন, 'এখানে পর্যটনের মতো এতো সুন্দর সুন্দর উপাদান আছে, যা রাঙামাটি কিংবা সিলেটের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এতদিন কেবল মোবাইলে দেখেছি। এই প্রথম আমি এসেছি। কিন্তু এখানকার কিছু সমস্যা রয়েছে। সেটা হলো- পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নেই। একটি পর্যটন এলাকায় যা যা থাকা দরকার তার অনেক কিছুই নেই। যদি এগুলোর সুব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এই এলাকাও পর্যটনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।'

উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাভিদ রেজওয়ান কবীর বলেন, 'এই উপজেলায় পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আমি সদ্য যোগদান করেছি। পর্যটন খাতের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। পর্যটকদের যে সমস্যায় পড়তে হয়, তা লাঘব করার জন্য কাজ করছি। আশা করছি যে, পর্যটকদের আমরা একটি সুন্দর পরিবেশ দিতে পারব।'

২০২১ সালের ১৭ জুন জিআই পণ্য সনদ পায় দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুরের পর্যটনস্পট সাদামাটির পাহাড়। এ ছাড়াও পাহাড়ি কন্যা নামে খ্যাত সোমেশ্বরী নদী, বিজয়পুর জিরোপয়েন্ট, কমলা বাগান, রানীখংমিশন, রাশিমনি স্মৃতিসৌধ, পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর পাহাড়, ফান্দাভ্যালিসহ রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য পর্যটন স্পট।