রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ১ আষাঢ় ১৪৩১

চুয়ারিয়াখোলায় জমে উঠেছে শত বছরের কুঞ্জমেলা

মাফুজা আফরিন মনি, কালীগঞ্জ (গাজীপুর)
  ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
চুয়ারিয়াখোলায় জমে উঠেছে শত বছরের কুঞ্জমেলা

শত বছর ধরে বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিকে বা ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহেই আশপাশের জেলার মানুষ ভিড় করেন চুয়ারিয়াখোলা গ্রামে। কারণ তখনই গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের এ গ্রামে জমে ওঠে ঐতিহ্যবাহী কুঞ্জমেলা।

জানা গেছে, চুয়ারিয়াখোলা গ্রামের শ্রী শ্রী কানাইলাল মন্দির কমিটির উদ্যোগে ৩ দিনব্যাপী এ মেলার আয়োজন করা হয়। প্রথম দিন খাবার সামগ্রী, দ্বিতীয় দিন দেশি-বিদেশি মাছ এবং তৃতীয় দিন খাবার সামগ্রী ও মাছ একসঙ্গে বসে মেলা প্রাঙ্গণে। রাধা-কৃষ্ণ যুগলের লীলাকীর্তি উপলক্ষে সনাতন ধর্মের লোকজন এ কুঞ্জ মেলার আয়োজন করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা টানা

১৫ দিন নিরামিষ খায় এবং মেলার শেষ দিন আমিষ খাদ্য গ্রহণ ও পূজা অর্চনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাদের আনুষ্ঠানিকতা।

তবে এ আয়োজন সীমাবদ্ধ থাকেনি সনাতনধর্মীদের মধ্যে। তা গ্রামের গন্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের জেলাগুলোর সব ধর্মের মানুষের মধ্যেও। মেলায় জামাতা ও আত্মীয়-স্বজনকে আমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করার রেওয়াজও চলে। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় খই, মুড়কি, নারকেল ও চালের নাড়ু। মেলা থেকে দই কিনে নিয়ে মুড়কি দিয়ে খাওয়ার রেওয়াজটিও ধরে রেখেছেন এলাকাবাসী।

সরেজমিন শুক্রবার সকালে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেল, পণ্যের পসরা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ও স্থানীয় এলাকা থেকে এসেছেন শতাধিক ব্যবসায়ী। মিষ্টান্ন, খেলনা, চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে ঘর-গৃহস্থালির বিচিত্র জিনিস নিয়ে এসেছেন তারা। মেলায় নিমকি-মুড়কি, ফুচকা-চটপটি, ঝালমুড়ি-চানাচুর, মিষ্টি ও জিলাপিই বিক্রি করা হচ্ছে ৫০টিরও বেশি দোকানে। বিক্রিও হচ্ছে দেদার। কারণ মেলায় এসে দর্শনার্থীরা নিমকি-মুড়কি, ফুচকা-চটপটি, ঝালমুড়ি-চানাচুর খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া শেষে যে মিষ্টি ও জিলাপি এবং ফল কিনেই বাড়ি ফিরতে হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে নাগরদোলা। আরও আছে হাতি, ঘোড়া, নৌকা ও নিশানা টার্গেট (শুট)।

ঢাকার ডেমরা থেকে পঞ্চাশোর্ধ সাহেরা বেগম কুঞ্জ মেলায় চুড়ি নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, তিনি এবার প্রথম এই কুঞ্জ মেলায় এসেছেন। বিভিন্ন জনের কাছে শুনে তার এখানে আসা। অনেক লোকজন এবং বেচাবেনাও ভালো। তবে মেলায় মহিলা ও শিশু ক্রেতাই বেশি বলে জানান তিনি।

মেলায় আসা শুটারম্যান জানান, ৪ বছর ধরে তিনি মেলায় আসেন। প্রচুর মানুষ দেখে তার খুব ভালো লাগে। তার কাছে মূলত শিশু-কিশোর ও তরুণ বয়সের লোকজন বেশি আসে। ৫ শুট ১০ টাকা। নিজের টার্গেট নিশানা দেখতে নানুর সঙ্গে এসেছে উপজেলার শিশুমেলা আইডিয়াল স্কুলের ৩য় শ্রেণির সৃজন রায়ও।

নরসিংদী থেকে খেলনার দোকান নিয়ে এসেছেন পঞ্চাশোর্ধ আফজাল উদ্দিন। তিনি বললেন, পুরানো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এখানকার কুঞ্জ মেলাটি। বেচাকেনা যাই হোক একসঙ্গে এত দর্শনার্থী দেখে ভালোই লাগে। একই কথা বলেন, দক্ষিণ চুয়ারিয়াখোলা গ্রামের চটপটি বিক্রেতা সুজন মিয়া (২৬), নরসিংদীর মনোহরদি থেকে নাগরদোলা নিয়ে আসা হানিফা (৩৫) ও কৃ? দাস (৪০)।

উপজেলার জাঙ্গালীয়ার রয়েন থেকে শুভাষ চন্দ্র দাস ও মোক্তারপুরের বাঘুন থেকে পরিমল চন্দ্র পাল মাটির তৈরি তৈজসপত্র নিয়ে এসেছেন। তাদের দোকানে পিঠা ও রুটি তৈরি পাতিল কিনতে ভিড় করেছেন তুমলিয়া ইউনিয়নের দড়িপাড়া গ্রামের গৃহবধূ শিখা সরকার, লিপি সরকার ও দিনা সরকার। মাটির তৈজসপত্র কিনতে আসা পঞ্চাশোর্ধ অবলা রানী দাস জানান, শীতের সময় গ্রামে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। তাই পিঠা তৈরির পাত্রের জন্য তিনি প্রতি বছর মেলায় আসেন।

মেলায় বাঁশ-বেতের তৈরি নানা রকম জিনিস নিয়ে আকবর আলী (৪৯) এসেছেন জামালপুর থেকে। তার সঙ্গে আসেন একই এলাকার ধীরেন্দ্র (৪৮)। তারা প্রতি বছর এই মেলায় আসেন। আগে বাপ-চাচারা আসতেন। তাদের বয়স হওয়াতে তারা এখন আর আসেন না। বংশ পরম্পরায় তারা আসেন।

শ্রী শ্রী কানাইলাল মন্দির ও মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি মুকুল চন্দ্র দে বলেন, ১শ বছর পূর্ণ হলো এই কুঞ্জ মেলার। মূলত পৌষ মাসের শেষের দিকে এই মেলা বসে। কানাইলাল মন্দিরে প্রতিদিন ও রাতে পালা হিসেবে ১৫ দিনব্যাপী রাধা-কৃ?ের লীলা কীর্তি উপস্থাপন করা হয়। একেবারে শেষের ৩ দিন হয় রাধা-কৃ?ের লীলা কীর্তি। লীলা কীর্তি করতে গেলে রাধা-কৃ?ের সেবা করতে হয়। আর সেবার জন্য মিষ্টি ও ফলসহ বিভিন্ন উপকরণ লাগে। সেই উপকরণের জোগান দিতেই শুরুতে ছোট্ট পরিসরে মন্দিরের অদূরে চুয়ারিয়াখোলা গ্রামে এই মেলার আয়োজন। দিনে দিনে এর পরিসর বেড়েছে। এখন বিভিন্ন রকমের শতাধিক দোকান বসে এই কুঞ্জ মেলায়। মেলা থেকে যে আয় হয় তা মন্দিরের কল্যাণ ট্রাস্টে জমা হয়।

তিনি আরও জানান, মেলা উপলক্ষে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয় না। ১শ বছর সময় ধরে এই দিনে মেলাটি বসে। দূরদূরান্তের মানুষ মেলায় যোগ দিতে আসেন। সে কারণে সব রকমের সুবিধা রাখতে আয়োজক কমিটি প্রায় এক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এবারও নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য মেলায় স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন রাখা হয়।

তুমলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুবকর বাক্কু মিয়া বলেন, গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলার ইতিহাস ধরে রাখতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছে শ্রী শ্রী কানাইলাল মন্দির কমিটির সদস্যরা। প্রতিবছর তারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে অব্যাহত রেখেছেন এই মেলার আয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে