বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি উন্নয়নে বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ

আলতাব হোসেন
  ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। মহামারি করোনাকালে ধান উৎপাদনে একধাপ এগিয়ে এখন বিশ্বে তৃতীয়। এছাড়াও পাট রপ্তানিতে বিশ্বে আবারও প্রথম বাংলাদেশ। ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম, সবজিতে তৃতীয়, মিঠাপানির মাছে তৃতীয়, আম উৎপাদনে বিশ্বে নবম, আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে বাংলাদেশ। বস্ন্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ। আর ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম।

এদিকে প্রথম বারের মতো জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদস্য হিসেবে কৃষি উন্নয়নে বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালের জুন মাসে এ পদে নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৯৩টি দেশ বাংলাদেশের কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও ফসল বৃদ্ধির কৌশল প্রয়োগ করছে। বিশ্বে বড় বড় কৃষি বিজ্ঞানীরা এখন বাংলাদেশে আসছেন টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধি ও জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষির জ্ঞান অর্জন করতে। দেশের খরা ও বন্যা সুহিষ্ণু ধানের জাত প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভালো ফলন দিচ্ছে। অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে নীতি ও নির্বাহী পর্যায়ে এফএও-এর কার্যক্রম, বাজেট বাস্তবায়ন, ফসলের উৎপাদন ভিক্তিক ফলাফল পর্যবেক্ষণ এবং পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণসহ এর প্রশাসনিক দিকগুলো তদারকিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ।

বিশ্বে কৃষিতে সেরা ১০ খাতে শীর্ষে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) স্বীকৃতি দিয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক অর্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় মাইলফলক বলে উলেস্নখ করেছেন বিশিষ্টজনরা। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখা, চালসহ কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত মাছ-মাংস রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশ।

কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে

দেশে বছরে গড়ে তিনটি ফসল হচ্ছে। পরিশ্রমী কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রয়াসে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের কৃষি বিষয়ক পরামর্শক ডক্টর নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার পর প্রতি হেক্টর জমিতে দুই টন ধান উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় টনেরও বেশি। হিসাব করলে তা ছয় টন আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি, উন্নতজাতের ব্যবহার ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনার ফলে দেশে ১৯৭১ সালের তুলনায় বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩শ' শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বর্তমানে দেশে আমন থেকে উৎপাদন হয় দেড় লাখ টন, আউশ হয় ৭০ হাজার টন, বোরো থেকে আসে দুই কোটি ১০ লাখ টন, গম উৎপাদন হয় ১২ লাখ টনের বেশি। এ ছাড়া ভুটা উৎপাদন হয় ৫০ লাখ টনের বেশি। দেশে বছরে সাড়ে চার কোটি টন বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। এরমধ্যে জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্ব উদাহরণ। দেশের খোরপোশ কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে উন্নীত হয়েছে। জিডিপিতে এখন কৃষির অবদান ৪ শতাংশ। কৃষিতে দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং অব্যবহিত পরে প্রায় সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে ে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। অথচ এখন দেশের লোকসংখ্যা প্রায় বিশ কোটি, পাশাপাশি প্রতিদিন আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ২০ শতাংশ করে। বাংলাদেশের খাদ্য সংকটকে ইঙ্গিত করে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে মন্তব্য করেছিলেন। বাংলাদেশ এখন আর খাদ্য সংকটের দেশ নয়। বাংলাদেশ এখন চাল-সবজিসহ খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ ১৪৪টি দেশে বাংলাদেশি কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে ১০৩ কোটি ডলার আয় এসেছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশের বেশি। ২০২১-২২ সালে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৮৯ কোটি ডলার।

এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক যায়যায়দিনকে বলেন, কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টর প্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের যেসব দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়তে পারে, তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। ১৯৭২ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ১১৭টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা ১০২টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা সংস্থা-বিনার বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণু খরাসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষুষ্ণ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা।

কৃষিবিদ শহিদুল ইসলাম বলেন, এক সময় 'মাছে-ভাতে বাঙালি' কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। ফলটির উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রায় সাড়ে নয় লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে। আলু উৎপাদন সাফল্যের এক বিস্ময়। এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। বর্তমানে দেশে দেড় কোটি টন আলু উৎপাদন হচ্ছে। আলু বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ১১৭টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা ১০২টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। প্রতিকূল ও অপ্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা সংস্থা বিনার বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন- যা বিশ্ব সেরা। বিশ্বে প্রথম জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন করেছেন বাংলার বিজ্ঞানীরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে