শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জলবায়ুর ক্ষতি বাড়লেও বাজেটে বরাদ্দ অপ্রতুল

আলতাব হোসেন
  ২৫ মে ২০২৩, ০০:০০
জলবায়ুর ক্ষতি বাড়লেও বাজেটে বরাদ্দ অপ্রতুল

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গড় তাপমাত্রা ও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ত হচ্ছে ফসলি জমি। এছাড়া খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভারী বর্ষণ, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, নদী ভাঙনে প্রতিনিয়ত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানির অভাব, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবিকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে। দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্রম্নতগতিতে ধ্বংস হচ্ছে সবুজ অরণ্য। বাড়ছে মরুকরণ এলাকা, এতে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছেন উপকূলের মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার।

দিনের পর দিন জলবায়ুর প্রভাব দৃশ্যমান হলেও জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় বাজেটে গড় বরাদ্দ কমছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য জলবায়ু অর্থায়নে জাতীয় বাজেটে জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দাবি করেছেন নাগরিক সমাজ। তারা বলছেন, গত ১০ বছরে জাতীয় বাজেটে আকার অনেক বেড়েছে। সেইসঙ্গে ১০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিও বেড়েছে। তবে সেই তুলনায় জলবায়ু তহবিলে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়েনি। যা পেয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল।

জাতিসংঘের জলবায়ু প্রতিষ্ঠান ইউএনএফসিসিসি'তে জমা দেওয়া ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনে (এনডিসি) নিজস্ব সক্ষমতায় ২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি, শিল্প, কৃষি, বন ও বর্জ্য খাতে ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন কমানো প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এ জন্য প্রতি বছর এক লাখ ৮৩ কোটি টাকার প্রয়োজন। এ জন্য জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ জলবায়ু খাতে বরাদ্দ দরকার। অথচ বাজাটে এক শতাংশ বরাদ্দ নেই। জলবায়ু তহবিলে অর্থ বাড়ানো প্রয়োজন।

ঢাকঢোল পিটিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার পাওয়ার আশায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি) গঠন করে। নিজস্ব বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে ২০০৯ সালে তহবিল গঠন করে সরকার। জলবায়ু তহবিলে ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২ সালে প্রতি অর্থবছরে ৭০০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪০০ কোটি, ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২০০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০০ কোটি করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০০ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরেও ১৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তারপর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০২২-২৩ বাজেটেও ১০০ কোটি কোটি বরাদ্দ দেওয়া হয়।

জলবায়ু বিষয়ক প্রতিষ্ঠান কোস্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক সৈয়দ আমিনুল হক বলেন, বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ অপ্রতুল। জলবায়ু অর্থায়নে সরকারের প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী জিডিপির কমপক্ষে ০২ শতাংশ বরাদ্দ ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, উপকূল সুরক্ষা ও বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রমকে সরকারের অগ্রাধিকার বিনিয়োগ খাত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, উপকূলের বাঁধ নির্মাণের জন্য পৃথকভাবে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় দারিদ্র্য-বান্ধব উন্নয়ন যেমন কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজনীয় চাহিদা অনুসারে হতে হবে। এই খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত।

জলবায়ু আইন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট হাফিজ আহমেদ বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ নেই। মাত্র ১৩ বছরে জলবায়ু তহবিল এখন তলানিতে। জনবল সংকট চরমে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় গঠন করা প্রতিষ্ঠানটিতে দক্ষ জনবলের অভাবে গবেষণা কার্যক্রম নেই। বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ আনার সক্ষমতাও নেই। মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করার প্রশিক্ষিত জনবলও নেই। নেই নিজস্ব ভবন, ঢাকার মহাখালীতে বন ভবনের পুরনো অফিসে জোড়াতালি দিয়ে চলছে ট্রাস্টের কর্মকান্ড। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮৫১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ইউএনএফসিসিসি'র কাছে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা-ন্যাপ জমা দিয়েছে। এটি ২০৫০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ের সঙ্গে ৮টি অগ্রাধিকার ক্ষেত্রজুড়ে ১১৩টি পদক্ষেপ চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ। এ জন্য এ খাতে বড় বরাদ্দ দরকার।

এ বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর সামসুল হক বলেন, সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব দিলেও প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানের। যেমন-২০২১ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে লাগানো হয়েছিল আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাস গাছ। এগুলো মাটির গুণ নষ্টের পাশাপাশি দেশীয় গাছেরও ক্ষতি করে। এছাড়া অধিকাংশ গাছ গরু ছাগলে খেয়ে নেয়। এর আগেও জলবায়ু তহবিলের টাকায় পার্ক নির্মাণ, ট্রাফিক বাতি, টয়লেট নির্মাণ, বিদেশে শিক্ষা সফর, পৌরসভার ড্রেন নির্মাণ, বড় শহরগুলোতে ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়, যা জলবায়ুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। দেশের যেসব এলাকা জলবায়ুর প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সেসব এলাকায় প্রকল্প হয়নি। অথচ প্রভাবশালী এমপি ও মন্ত্রীদের এলাকায় জলবায়ু তহবিলের টাকায় বেশি প্রকল্প হয়েছে। জলবায়ু তহবিলের টাকা যথাযথ ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে এই খাতে আরও টাকা বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বিজয় সরকার বলেন, জলবায়ু তহবিল বরাদ্দের নীতিমালা সংশোধন করা প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা বাড়াতে জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। ট্রাস্টের নিজস্ব জমিতে স্থায়ী ভবন দরকার। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রকল্প নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের মহাপরিচালক পরিচালক নূরুন নাহার হেনা বলেন, বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। অবশিষ্ট ৬৬ শতাংশ ব্যয় করা যায়। ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেলেও ১৯৮ টাকা খরচ করা যাবে। ব্যাংকের জমাকৃত টাকার লভ্যাংশ টাকায় এখন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এ খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ প্রয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে