সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম ও কেরানীগঞ্জের কামারপাড়ায় ব্যস্ততা বেড়েছে, বাড়েনি বিক্রি

নুরউদ্দীন খান সাগর, চট্টগ্রাম ও মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ২৭ জুন ২০২৩, ০০:০০

কোরবানির ঈদের আর মাত্র দুদিন বাকি। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম ও ঢাকার কেরানীগঞ্জের লৌহশ্রমিকদের (কামার) ব্যস্ততা বেড়েছে। হাপরের বাতাসে কয়লায় পোড়ানো হচ্ছে লোহা। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি হচ্ছে চাপাতি, দা, ছোট বড় ছুরি, বঁটি, ধামা। সারা বছর কাজ কম থাকলেও কোরবানির সময় ঘনিয়ে আসায় ব্যস্ততায় কাটাচ্ছেন তারা।

তবে কয়লা ও লোহার দাম বাড়ায় এ বছর মাংস কাটার সরঞ্জামে বাড়তি দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। বিশেষ করে চাহিদা থাকায় পশু জবাইয়ের বড় ছুরি ও চামড়া ছাড়ানোর ছোট ছুরি বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ক্রেতারাও ভিড় জমাচ্ছেন নগরের বিভিন্ন কামারশালায়। তাছাড়া অনেক বিক্রেতা আবার ভ্যান নিয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকার গলিতে গলিতে দা, ছুরি, ধামা বিক্রি করছে।

উত্তর চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, মিরসরাই, সন্দ্বীপ, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগড়া এবং নগরীর পাহাড়তলী, আকবরশাহ, বিশ্বকলোনি, ফিরিঙ্গি বাজার, মুরাদপুর, দেওয়ানহাট ও হালিশহর এলাকার বেশকিছু কামারশালায় ব্যস্ততা দেখা গেছে। প্রতি পিস চামড়া ছাড়ানোর ছুরি ২শ থেকে ২৫০ টাকা, প্রতি পিস বটি প্রকার ভেদে ৬৫০ থেকে ৮৫০ টাকা, পশু জবাইয়ের ছুরি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা, প্রতি পিস কুড়াল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, কাটারি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, চাপাতি ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা, ধামা ৭৫০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা ও হাঁসুয়া ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আকবরশাহ কামারের দোকানে কথা হয় ক্রেতা জোহেব খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ঈদ যত কাছে আসছে কামাররা সরঞ্জামের দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ৫ মাস আগে ভালো মানের একটি ছুরি ২৫০ টাকায় কিনেছিলাম। এখন ৩শ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত করতেও বেশি দাম নিচ্ছেন কামাররা।'

কেরানীগঞ্জের জিনজিরা তাওয়াপট্টি, রোহিতপুর বাজার, আব্দুলস্নাহপুর, কলাতিয়া বাজার, বাস্তা বাজার, হযরতপুর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় পশু কোরবানির জন্য দা, ছুরি, চাপাতিসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে কামারপাড়ায় ঢুঁ মারছেন সাধারণ মানুষ। কেউবা আসছেন পুরনো দা-বটি-ছুরিতে শান দিতে। শান দেওয়া নতুন দা, বঁটি, ছুরি ও চাকু সাজিয়ে রাখা হয়েছে দোকানের সামনে। দোকানের জ্বলন্ত আগুনের তাপে কামারদের কপাল থেকে ঝরছে ঘাম। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। তবুও থেমে নেই তারা। সকাল পেরিয়ে রাত পর্যন্ত চলছে হাতুড়ি পেটানোর কাজ।

উপজেলার বারোটি ইউনিয়নে ১৯০ থেকে ২০০টি কামার পরিবার রয়েছে। এসব এলাকার কামাররা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তৈরি করছেন নানা সরঞ্জাম। তবে আগের মতো লোহা আর হাতুড়ির ঝনঝনানি কামার বাড়িতে শোনা যায় না। ঈদ ও ফসলের মৌসুমে কাজের চাপ থাকলেও বাকি সময়টা অলসতায় পার করতে হয়।

জিনজিরা তাওয়াপট্টি এলাকার সাধন কর্মকার (৬২) বলেন, 'আমি ৪০ বছর ধরে এ পেশায় আছি। এর আগে এ কামার শিল্পের অনেক কদর ছিল। কিন্তু এখন কয়লাসহ অন্যান্য মালামালের দাম বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা আর আগের মতো নেই। বর্তমানে কোনোরকম বেঁচে আছি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমার ছেলেকে বাপ-দাদার পেশায় আনতে চাই না। ওকে অন্য পেশায় দিতে চাই। এ পেশায় দিনে দিনে লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। আগের মতো কাজ হয় না।' রঞ্জিত কর্মকার বলেন, 'লোহা পিটিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা আমাদের পেশা, একটি মাঝারি ধরনের দা ও কাটারি তৈরি করে ওজন অনুযায়ী ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যে কয়টি জিনিস তৈরি করি, তা বিক্রি করে খুব বেশি লাভ না হলেও পরিবার-পরিজন নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি। আদি এই পেশা আমরা ধরে রেখেছি। তবে সারাবছর কাজ-কর্মের ব্যস্ততা তেমন না থাকলেও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আমাদের ব্যস্ততা বেড়েছে।'

রোহিতপুর ইউনিয়নের গণেশ চন্দ্র কর্মকার জানান, 'বাপ-দাদার পর ওই সূত্র ধরে আমার জীবনের শেষ মুহূর্তেও এই পেশা ধরে রেখেছি। সারাদিন কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে বাঁচি। এই পেশা ছেড়ে অন্য কোনো ভালো পেশায় যে যাব, এই রকম আর্থিক সঙ্গতি আমার নেই। তবে সরকারিভাবে এবং এনজিওর মাধ্যমে আমাদের কামারদের সুদমুক্ত ঋণ দিলে এবং পাইকারি মূল্যে উপকরণ কিনতে পারলে অবশ্যই এই দেশীয় কামার শিল্প আগের মতো ঘুরে দাঁড়াবে।'

সরকারি চাকরিজীবী বাদশা হাওলাদার পুরানো ছুরি, চাপাতি, বঁটি শান দিতে নিয়ে এসেছেন জিনজিরা বাজারের তাওয়াপট্টিতে। তিনি বলেন, 'এবার সরঞ্জামের যেই দাম, তাই আগেরগুলোই ধার দিয়ে নিচ্ছি। এমনিতেই বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। নতুন করে এখন টাকা খরচ করার সুযোগ নেই। তাই আগেরগুলো দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। শুধু নতুন করে একটি চাপাতি কিনতে হয়েছে।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক ও কেরানীগঞ্জ শিল্প সহায়ক কেন্দ্রের (বিসিক) সভাপতি হোসাইন এ শিকদার বলেন, 'লোহা, কয়লাসহ এই শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম এখন বেড়ে গেছে। বেশি দাম দিয়েও আবার মানসম্পন্ন কাঁচামাল পাওয়া যায় না। যে কারণে পরিশ্রম এবং খরচের তুলনায় আয় কম হয়। এসব কারণে এ কাজের সঙ্গে জড়িত অনেকেই পেশা পরিবর্তন করছেন। তবে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বিসিক কাজ করছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।'

এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. ফখরুল আশরাফ বলেন, 'কামারদের বিষয়ে গরিব এলাকা দেখে বিভিন্ন এলাকায় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা এরইমধ্যে জরিপ করেছি। জরিপের তথ্য পাঠানো হয়েছে। আমাদের প্রকল্প চলমান।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে